আনোয়ার হোসেন রনি:দেশের এক সময়ের সবচেয়ে ক্ষমতাধর পদে থাকা সাবেক পুলিশপ্রধান মামুন। দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি ক্ষমতা, প্রভাব, নির্দেশ–সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন। তাঁর একটি ফাইলে বদলে যেত মানুষের ভাগ্য, তাঁর নির্দেশেই নড়ে চড়ে বসত পুরো প্রশাসন। সেই মানুষটিকেই আজ দেখা গেল আদালতের কাঠগড়ায়—নিঃশব্দ, নিস্তব্ধ, মাথা ঝুঁকিয়ে এক হাতে তসবিহ ধরে জপতে।
রায়ের দিন ট্রাইব্যুনালের চত্বরে যখন বিচারক এজলাসে প্রবেশ করলেন, বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল চাপা উত্তেজনা। উপস্থিত জনতা, আইনজীবী, সংবাদকর্মী—সবাই তাকিয়ে থাকলেন কাঠগড়ার দিকে। সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন মামুন। আর পাঁচজন আসামির মতো নয়—বরং এমন এক ব্যক্তি, যিনি কখনো ভাবতেও পারেননি।আইনিভাবে নিজেকে রক্ষা করতে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।
প্রভাবশালী ক্ষমতার মানুষ থেকে রাজসাক্ষী
মামুনের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ, বিচারের নানা প্রক্রিয়া, সাক্ষ্য–প্রমাণ—সব মিলিয়ে মামলাটি আলোচিত ছিল দীর্ঘদিন। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে তিনি হয়ে গেলেন রাজসাক্ষী। এক সময় যাঁর কথায় ক্ষমতাসীন মহলও কেঁপে উঠত, সেই তিনিই আজ নিজের বাঁচার আশায় বলছেন—“আমি সত্য বলব।”
এ যেন এক অদ্ভুত বৈপরীত্য। ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে দাঁড়ানো মানুষটি আজ বলেছেন, তাঁর পাশে আর কেউ নেই। রাজসাক্ষী হওয়ার পর থেকে তাঁর চারপাশের গণ্ডি আরও সংকুচিত হয়েছে। যাঁরা একসময় তাঁর সান্নিধ্য পেতে প্রতিযোগিতা করতেন, এখন তাঁরা অনেক দূরে।
তসবিহ হাতে কাঁপা হাত—বিবেকের কান্না
রায় ঘোষণার সময় মামুনকে দেখা যায় তসবিহ হাতে নিয়ে জপতে। হাত দুটো কাঁপছিল, চোখ স্থির ছিল না। আদালতের ভেতরের নীরবতা আরও ভারী হয়ে উঠেছিল তাঁর ভঙ্গীতে। ভাবনা ভেসে ওঠে—নিঃসঙ্গ এই মানুষটি হয়তো জীবনের সবচেয়ে কঠিন মুহূর্তের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছেন।
যে হাত একসময় নির্দেশ দিত, যে হাত দিয়ে তিনি বহু সংঘটনের নিয়ন্ত্রণ করতেন, সেই হাতই আজ প্রার্থনায় কাঁপছে।
মানুষ যখন সব পথ হারিয়ে ফেলে, তখন সে নিজের ভিতরের দিকে তাকায়—এই দৃশ্য যেন তারই বাস্তব প্রতিচ্ছবি। ক্ষমতার দেয়াল ভেঙে যায়, কিন্তু দায়বদ্ধতা থেকে পালানো যায় না
আইনি রায় হয় আদালতে, কিন্তু শাস্তির শুরু হয় মানুষের ভেতর থেকেই—এ দৃশ্য যেন তারই প্রমাণ। অনৈতিক সিদ্ধান্ত, অন্ধ আনুগত্য বা ক্ষমতার অপব্যবহার—সেসব সময় মানুষকে সাহসী দেখালেও, শেষ পর্যন্ত বিবেকের আদালতে কেউই রেহাই পায় না।
মামুনের মুখের গভীর নীরবতা যেন সেই দায়বদ্ধতার প্রতীক। ক্ষমতার দিনগুলো যতই উজ্জ্বল ছিল, বিচার-আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে তিনি বুঝতে পারছেন—ক্ষমতা সবসময় পাশে থাকে না। আজ তিনি রাজসাক্ষী, হয়তো জীবন রক্ষার শেষ চেষ্টা। কিন্তু নিজের ভিতরের দায় কি এভাবে মুছে যায়? তিনি নিজেও হয়তো সেই প্রশ্নের উত্তর জানেন না।
সমাজের জন্য শিক্ষা রায়ের দিন আদালতের সেই তসবিহ জপা দৃশ্যটি সমাজের জন্য এক গভীর বার্তা রেখে গেল। ক্ষমতা, পদ, প্রভাব—সবই সময়ের কাছে ক্ষণস্থায়ী। কেউ শক্তি, ক্ষমতা বা অস্ত্রের জোরে অন্যায়কে ঢেকে রাখলেও শেষ পর্যন্ত সত্যই সামনে এসে দাঁড়ায়। আর তখন বুঝতে হয়—ক্ষমতা নয়, সততাই মানুষকে রক্ষা করে।মামুনের জীবনের এই অধ্যায় তাই শুধু একটি মামলার গল্প নয়—এটি সতর্কবার্তা, শিক্ষা এবং স্মরণ করিয়ে দেওয়া—কোনো অন্যায় চিরদিন লুকিয়ে থাকে না।জীবন ঘুরে দাঁড়ায়, মানুষ কাঠগড়ায় দাঁড়ায়, আর ইতিহাস নিজস্ব ভাষায় সত্যকে তুলে ধরে।
