আনোয়ার হোসেন রনি: বাংলাদেশের একটি ঐতিহাসিক অধ্যায় আজ আঁধারগ্রস্ত হয়ে গেছে,তার নাম ছিল বেগম খালেদা জিয়া,যিনি হারালেন জীবন, পেলেন অমরত্বের ঠিকানায় প্রবেশের ঠিকানা।
মঙ্গলবার ভোর ৬টা —ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালের নিঃসঙ্গ পথচলায় চিরকালের সাথী হলেন তিনি;মেডিক্যাল যন্ত্রের ঢেউয়ের পেছনে বুকে যে ব্যথার টান,জীবনের শেষ নিশ্বাস নিল সেই ব্যথাই —“ইননালিল্লাহি ওয়া ইন্নালিল্লাহি রাজিউন।”ঐ শহরের সেই করিডোরে,সেদিন ভোরের প্রথম আলো এসে পড়লে হাসপাতালের কংক্রিট ধারগুলো যেন কাঁপছিল। সারা দেশের চোখ ছিল ঐ সব ঘর আর শয্যার দিকে,হাসপাতাল বাড়ির পরিবেশ যেন অস্থির, মাইক্পটের খসখসে শব্দে,ডাক্তারদের পদধ্বনি শুনায়,ক্যানভাসের কুয়াশা ভেদ করে একটি বড় খবরের আগমন —এক ঐতিহ্যের বিপুল শূন্যতার সূচনা।
তিনি ছিলেন —দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী,যিনি রাজনীতির কঠোর স্রোতে দাঁড়িয়ে কখনো পড়ে গেছেন, কখনো আবার উঠে দাঁড়িয়েছেন।বাংলাদেশের রাজনীতি তাকে চেনে শুধুই আপসহীন নেত্রী’ নামে—যেখানে বিতর্ক, যেখানে অনুকরণীয় দৃঢ়তা,সেখানে তাঁর উপস্থিতি ছিল অটল,অবিচল, অনমনীয়।
তার জীবন—একটি দীর্ঘ রাজনৈতিক মহাকাব্য,
যেখানে আছে সংগ্রাম,আছে বিরোধ,আছে অসংখ্য ওঠাপড়া —এবং সবকিছুর মত্তে দাঁড়িয়ে তিনি নিজেকে স্থির করেছিলেন,একটি অটল মনোবল,যা চিরকালই প্রতিদ্বন্দ্বীদের দিকেই তাকিয়ে ছিল।স্মরণীয় রাজনৈতিক পথচলা
বেগম খালেদা জিয়া—একটি নাম,একটি ঐতিহ্য,একটি পরিচয় —বাংলাদেশের এক না ফেরার পথে পা রাখা রাজনৈতিক নেত্রী।
১৯৭৪ সালে তার স্বামী লেফটেন্যান্ট কর্নেল শহীদ জিয়াউর রহমান আত্মারাজ্যে প্রবেশ করলে,একটি বিরাট ক্ষতি যেন গোটা দেশের রাজনীতিতে নীরবতা সৃষ্টি করে।তারপর থেকে,একজন বিধবা,একজন মায়ের ক্ষত,একজন রাজনৈতিক উত্তরাধিকারের দায়ভার—সব মিলিয়ে জন্ম নেয়
একটি অনন্য রাজনৈতিক শক্তি।বিভিন্ন সময়,বহু দফা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেন,দেশের সর্বোচ্চ দায়িত্বে,প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন তিনবার।তার নেতৃত্বে বাংলাদেশের পুর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলে অনেক উন্নয়ন, বিতর্ক,রাজনৈতিক উত্তেজনা,সরকার-ঐক্য, বিরোধী সংঘাত —
সব কিছুর সাক্ষী ছিল এই মনুষ্যশক্তি।
তার সময়সীমা —অনেক মানুষের কাছে আদর্শ,
অনেকের কাছে ছিল কঠিন সিদ্ধান্তের প্রতিচ্ছবি।
কিন্তু রাজনীতির মাটিতে,যেখানে চিন্তা ভিন্নধারার,
ধারণা বিরোধিতার,প্রতিযোগিতার —সেখানে তিনি কোনোদিনই পিছিয়ে যাননি।অসুস্থতার অগ্নিপরীক্ষা ও শেষ দিনগুলো গত কয়েক বছর ধরেই শরীর যুদ্ধ করছিল ক্লান্তির সাথে,একাধিক জটিলতা হয়ে দাঁড়িয়েছিল তার প্রতিরোধের পথচিহ্নে। লিভার, কিডনি,হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ,ডায়াবেটিস, আথ্রাইটিস —এই সব নাম যেন একটুকরো কাগজের টুকরো হয়ে দাঁড়ায় এক মহৎ মনের বুকে প্রতিদিনের যন্ত্রণায়। ২০১৫ সাল থেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায়, সংবাদপত্রে,সবার মুখে ছিল তার রোগ ও চিকিৎসার খবর —কিন্তু তিনি প্রতিবারই
হাসিমুখে ফিরেছেন,আবারও সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন।রাজনৈতিক মঞ্চে,সম্মেলনে,বক্তৃতায় —তার উপস্থিতি ছিল অনিবার্য যেন।
তবে গত ২৩ নভেম্বর,যখন তিনি ভর্তি হন ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে,রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলেছিলেন“এটি আর এক সাধারণ অভ্যাসগত ভর্তি নয়।”তার শরীরে জটিলতার সংখ্যা বেড়ে গেল একাধিক স্তরে। হাসপাতালের সাদা দেয়ালের ভাঁজে ভাঁজে যেন আবর্তিত হচ্ছিল
জীবনের শেষ পাঠ। হাসপাতালের ওই করিডোরে,
ভোরবেলার অন্ধকারটা যেন একটু ধীর,একটু ভারাক্রান্ত মনে হতো।ডাক্তার, নার্সরা চোখে চোখ রাখছিলেন প্রত্যাশার আলো আর অনিশ্চয়তার ছায়া—আপেক্ষিকতার একটু একটু মিলনে।তার নিজস্ব চিকিৎসক, অধ্যাপক এজেডএম জাহিদ হোসেন,কেউ জানতেন —ব্যাথার অগ্নিপর্ব কীভাবে শেষ পর্যন্ত অপরাজেয় হয়ে দাঁড়াবে।
রাত ২টার পর ডাক্তার সামনের গ্যালারিতে এসে বললেন —“খালেদা জিয়া অত্যন্ত সংকটময় অবস্থায় রয়েছে। তার পরিবারের পক্ষ থেকে দেশবাসীকে দোয়া করার অনুরোধ করছি।”
যে অনুরোধে ছিল হাহাকার,দেশজুড়ে তাতে সাড়া পড়েছিল হৃদয়ের গভীরে।শেষ নিশ্বাস: ভোর ৬টা, মঙ্গলবার মঙ্গলবার ভোর ৬টা —একটি ক্ষণস্থায়ী মুহূর্ত,কিন্তু ইতিহাসে দাগ কেটে গেছে চিরস্থায়ীভাবে। ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালের শনিবাড়িতে,যেখানে চিকিৎসার সমস্ত চেষ্টা চলছিল,সেখানে শেষমেশ জীবন আজ সমাপ্তি পেল। ডাক্তার ঘোষণায় বললেন —“তিনি আর নেই।”একটি বাক্য —একটি শব্দের ভাঙা সুর,
যা সেই স্থির ঘরে প্রতিবার প্রতিধ্বনিত হল।
সেসময় হাসপাতালের পরিবেশ শোকের ভারে ভারাক্রান্ত,চোখে পানি,হৃদয়ে ব্যথা;ডাক্তার-বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন। সেইসময় হাসপাতালের করিডোরে
মানুষদের চোখে অশ্রুজল,হৃৎকম্পে যেন ইতিহাস itself শোকাহত রূপে দাঁড়িয়েছিল।
পরিবার ও রাজনৈতিক মহলের উপস্থিতি
শোকের সেই মুহূর্তে হাসপাতালের সামনে ছিল
তার বড় ছেলে,বিএনপি ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান,তার স্ত্রী জুবাইদা রহমান, তার মেয়ে জাইমা রহমান,এছাড়াও প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী সৈয়দা শামিলা রহমান,দু’সন্তান জাহিয়া রহমান ও জাফিয়া রহমান,ছোট ভাই শামীম এস্কান্দার,তার স্ত্রী কানিজ ফাতেমা,
প্রয়াত সাইদ এস্কান্দারের স্ত্রী নাসরিন এস্কান্দার,
এবং মেজ বোন সেলিনা ইসলামসহ অনেক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়—সকলেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
এরা শুধুই নাম নয় —একটি পুরো পরিবার,
যাদের হৃদয়ের প্রতিটি স্পন্দনে ছিল প্রেম, আদর,
আশা আর শূন্যতার মিলন। এমন শোক সংবাদ মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল শহরেও, গ্রামেও,সোশ্যাল মিডিয়ায়,বিশ্বজুড়ে।
মানুষ শোক প্রকাশ করল,কেউ পেয়েছে স্মৃতিচারণা,কেউ হারানোর বেদনাপূর্ণ অনুভূতি —একসময়ে একজন নেত্রী,
তখন আজ শুধুই স্মৃতি।দেশজুড়ে প্রতিক্রিয়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দল,ক্ষমতা ও বিরোধী উভয় মহলেই শোকের ছায়া নেমে আসে।নিজ নিজ ভাষায় তাঁদের বিবৃতি,তাঁরা বলেছেন —“একটি অধ্যায়ের সমাপ্তি।”একজন প্রবল নারী নেত্রীর চিরবিদায়।”“বাংলাদেশ রাজনীতির এক মহৎ ইতিহাস।”এমনসব কথার ভীর,ভর্তি ছিল শ্রদ্ধায়,
ভরা ছিল সম্মানে। সোশ্যাল মিডিয়া যেন এক বিরাট স্মৃতিচারণার মঞ্চ —লোকাল পোস্ট, ভিডিও,ছবি, স্মৃতি —সবাই নিজের মতো করে শোক প্রকাশ করল। কারো চোখে কলমে,কেউ আবার মন দিয়ে লিখল,তাঁর অবদান ভুলবো না।”“তিনি ছিলেন অটল। একজন সংগ্রামী নারী।”
এক রাজনৈতিক জীবনের উত্তরাধিকার বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক যাত্রা কেবল ব্যক্তিগত ছিল না —এটি ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক দীর্ঘ অধ্যায়।
বিরোধ, সমালোচনা,অনুকরণীয় সংগ্রাম —সব মিলিয়ে গড়ে উঠেছে এক অপরিসীম রাজনৈতিক ঐতিহ্য। তিনি কখনো রাজনৈতিক সংগ্রাম থেকে সরে যাননি;কিন্তু ইতিহাস নারীর ক্ষমতায়ন, নেতৃত্ব,আদর্শ, সংগ্রাম —এই সব ধারায় আজ তাঁর নাম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকল।তাঁর রাজনৈতিক জীবনের স্মৃতি,তার বক্তৃতা,তার সিদ্ধান্ত,তার অবস্থান —এগুলো আজ ইতিহাসের পাতায় চিরজীবী হয়ে গেছে। বেগম খালেদা জিয়া —একজন প্রধানমন্ত্রী,একজন নেত্রী,একজন মা,একজন সংগ্রামী—আজ যখন আমাদের মাঝে নেই,তাঁর স্মৃতির রেখা
চিরকাল স্মৃতিপটে অম্লান হয়ে থাকবে।“ইননালিল্লাহি ওয়া ইন্নালিল্লাহি রাজিউন।”
হৃদয়ের গভীরে অদৃশ্য হলেও, তার আদর্শ,তার রাজনৈতিক পথ —চিরদিন আমাদের স্মরণে বিরাজ করবে। আল্লাহ তাঁকে ভালবাসা, ক্ষমা ও বেহেশতের উচ্চতম স্থান দান করুন —এই শুধু আমাদের প্রার্থনা।
লেখক ও কবি, সাংবাদিক আনোয়ার হোসেন রনি
৩০,১২,২৫ইং মুঠোফোন-০১৭১১৪৪৭৬৮৬.
