অফুরান রহমত ঝরুক ভাষা শহিদদের আত্মায়:মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান

0
194

আমার সিলেট ডেস্ক: বাংলা আমাদের মাতৃভাষা। এ ভাষা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের দান। কবি ফররুখ আহমদ গানে গানে বলেছেন-‘ও আমার মাতৃভাষা বাংলাভাষা/খোদার সেরা দান/বিশ্বভাষার সবই তোমার/রূপ যে অনির্বাণ।’
প্রত্যেক জাতিরই কোনো না কোনো বৈশিষ্ট্য আছে। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের যে এক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছেন, তা হলো আমাদের নিখাঁদ মাতৃভাষা প্রীতি। ভাষার জন্য বুকের রক্ত ঢেলে দেওয়া। এভাবে রক্ত দিয়ে ভাষার প্রেমকে কালজয়ী করা যেন মাতৃপ্রেমেরই জ্বলন্ত প্রকাশ।
মাতৃভাষার গুরুত্ব সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে কারিমে ইরশাদ হয়েছে-‘আমি কোনো নবিই(অদৃশ্যের সংবাদদাতা) এমন পাঠাইনি, যে তার জাতির মাতৃভাষায় আমার বাণী তাদের কাছে পৌঁছায়নি, যাতে করে সে তাদের কাছে আমার আয়াতগুলো পরিষ্কার করে বুঝিয়ে বলতে পারে।’ (সূরা ইবরাহিম, আয়াত নং-৪)।
আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা বাংলা দাবি করায় তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক যাদের শহিদ করা হলো তারা হলেন-রফিক, সালাম, জব্বার, বরকত প্রমুখ। আমাদের জানামতে, তারা সবাই ছিলেন মুসলিম, যাদের নাম আমরা অত্যন্ত গৌরবের সঙ্গে উচ্চারণ করে থাকি, এরা মুসলিম ও মজলুম হওয়ার কারণে আমরা তাদের শহিদ হিসাবে অভিহিত করে থাকি।
তাদের স্মরণে প্রতিষ্ঠিত হাজার হাজার শহিদ মিনার আছে বাংলাদেশে। ভাষাকে নিয়ে এ ধরনের নজির পৃথিবীর আর কোনো দেশে নেই, কখনোই ছিল না। কিন্তু আমাদের দেশের সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষ এ ভাষা দিবস উদযাপনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করছেন না, এটি একটি অস্বস্তির বিষয়।
কত সাধারণ কারণে ও তুচ্ছ ঘটনায় নিহতদের স্মরণে আমাদের আলেম ও হাফেজদের দিয়ে আমরা কুরআনখানি, মিলাদ মাহফিল, দেওয়া-মোনাজাত করে থাকি। কিন্তু ভাষা শহিদদের জন্য কি আমাদের কোনো দায়িত্ব নেই? এ শহিদদের ত্যাগ আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। তাই আমাদের উচিত কুরআনখানি, মিলাদ-মাহফিল, আলোচনা সভা, দোয়া ও মোনাজাত করে তাদের আত্মার রহমত ও শান্তি কামনা করা।
আমাদের ভাষা শহিদরা তাদের টগবগে যৌবনকে বিসর্জন দিয়ে, ইহকালীন সব ভোগ-বিলাসকে তুচ্ছ জ্ঞান করে আমাদের প্রিয় বাংলাভাষার জন্য তাজা জীবনকে বিলিয়ে দিয়েছেন। তাই তারা আমাদের ওলামায়ে কেরামের এবং মুসলমানের দোয়া পাওয়ার যোগ্য।
আমাদের ভাবতে হবে পূর্ববর্তী ওলামায়ে কেরাম মাতৃভাষার জন্য কী আবদান রেখে গেছেন। এ ব্যাপারে মরুহুম মাওলানা আকরম খাঁর কথা গর্বভরে উচ্চরণ করা যায়। তিনি সংবাদপত্রের মাধ্যমে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে সফল করার জন্য ডাক দিয়েছিলেন।
তাছাড়া হজরত মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরীও (রহ.) ভাষা আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন। সুতরাং আমাদের ওলামায়ে কেরাম ভাষা শহিদদের অবদানের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে নবচেতনায় উদ্বুদ্ধ হবেন এমনটাই আমাদের প্রত্যাশা।
পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ বাংলাদেশের সব শহিদ মিনারে কুরআন তেলাওয়াত, মিলাদ মাহফিল, দোয়া ও মোনাজাত ইত্যাদি অনুষ্ঠানের জন্য রাষ্ট্রের দায়িত্ব নেওয়া উচিত। আমাদের দেশের সব সরকারপ্রধান তাদের আপনজনদের জন্য কুরআন তেলাওয়াত, মিলাদ মাহফিল ও দোয়া-মোনাজাত ইত্যাদির মাধ্যমে মাগফিরাত কামনা করে থাকেন।
তবে ভাষা শহিদদের মাগফিরাতের জন্য অবশ্যই এসব কাজে সরকারপ্রধান সহযোগিতা করবেন। আমাদের বিশ্বাস দেশের শহিদ মিনারগুলোতে একবার কুরআনুল কারিমের আওয়াজ তুলতে পারলে তা প্রতি বছরই চলতে থাকবে এবং তা আস্তে আস্তে ব্যাপকতা লাভ করবে। সমর্থন বাড়বে সাধারণ মানুষের এবং তারাও এ মহৎ কাজে শরিক হবেন। গোটা দেশ একসঙ্গে কুরআন মাজিদের সুর তুলবে। এভাবেই ভাষা দিবসের সত্যিকার চেতনা চারদিকে ছড়িয়ে পড়বে।
মাতৃভাষা দিবসে দেশের প্রতিটি মসজিদ-মাদ্রাসায় মাতৃভাষার ওপর আলোচনা সভা, রচনা প্রতিযোগিতা ও ইসলামি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও করা যেতে পারে। ভাষা দিবসকে নিয়ে বাড়াবাড়ি বা অপসংস্কৃতি যেমন কাম্য নয়, তেমনি কম্য নয় গণমানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগকে প্রতিহত করাও।
ভাষা আল্লাহপাকের অপার দান। প্রত্যেক জাতির কাছে তাদের মাতৃভাষার মর্যাদা যেমন অপরিসীম, তেমনি আল্লাহতায়ালার কাছে কোনো ভাষাই ছোট নয়। তিনি সব ভাষা জানেন ও বোঝেন। যে যেভাবেই তাকে ডাকেন না কেন তিনি বোঝেন, উত্তর দেন, তার সঙ্গে কথা বলেন।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহপাক বলেন, ‘আর আমরা প্রত্যেক রাসূলকে তার জাতির ভাষাতেই ওহিসহ পাঠিয়েছি, যাতে করে সে স্পষ্টভাবে আমাদের কথা তাদের বুঝিয়ে দিতে পারে’ (সূরা ইবরাহিম : ৪)। সব জাতিকে হেদায়াতের জন্য যেমন আল্লাহপাকের পয়গাম্বর এসেছেন, তেমনি সব জাতির স্ব-স্ব ভাষাতেই আল্লাহতায়ালার ওহি-ইলহাম নাজিল হয়েছে।
আল্লাহতায়ালা প্রত্যেক জাতির মাতৃভাষাকে যথাযথ মর্যাদা দিয়ে তাদের নিজস্ব ভাষায় আসমানি কিতাব অথবা কিতাববিহীন ওহি পাঠিয়েছেন। একেক জাতির জন্য একেক ভাষা সৃষ্টি করা এটা আমাদের ওপর আল্লাহতায়ালার বিশেষ কৃপা। আর না হয় মানুষ ভাষার মর্যাদা বুঝত না। মানুষের ভাষা ও বর্ণের বিভিন্নতার সঙ্গে তার উন্নতি অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।
আল্লাহপাক বলেন, ‘আর তার নির্দেশনাবলির মাঝে রয়েছে আকাশগুলোর ও পৃথিবীর সৃজন এবং তোমাদের ভাষা ও রঙের বিভিন্নতাও। নিশ্চয় এতে জ্ঞানীদের জন্য অনেক নিদর্শন রয়েছে’ (সূরা আর রুম : ২২)। ভাষা ও রঙের এ বিভিন্নতা সুপরিকল্পিত, যার পশ্চাতে পরিকল্পনাকারীর অস্তিত্ব বিদ্যমান। আকাশমালা ও বিশ্বজগৎ সেই পরিকল্পনাকারীর সৃষ্টি।
বর্ণের ও ভাষার বিভিন্নতার ফলে বিভিন্ন সভ্যতা ও সংস্কৃতির আগমন-নির্গমন ঘটে চলেছে। কিন্তু তবুও এ বিভিন্নতার অন্তরালে স্থায়ীভাবে প্রবহমান রয়েছে একটি বিশাল একতা ও মানবতার ঐক্য। আর মানবতার এ ঐক্য যুক্তিগ্রাহ্যভাবে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে যে সৃষ্টিকর্তাও একজনই। মানবজাতির সূচনালগ্নে ভাষা ছিল একটিই এবং তা ছিল ইলহামি ভাষা।
এরপর মানুষ বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ার ফলে এলাকা পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ভাষারও পরিবর্তন হতে থাকে। এভাবেই সূচনাতে মানুষের রংও ছিল একই রকম। এরপর গ্রীষ্ম, শীত এবং নাতিশীতোষ্ণ অবস্থা অনুযায়ী তার রঙেরও পরিবর্তন হতে থাকে।
আমাদের ভাষা হচ্ছে বাংলা, কেউ যদি ভাবেন যে, বাংলাতে আল্লাহপাকের কাছে চাইলে তিনি কি তা শুনবেন? এর উত্তরে বলা যায়, অবশ্যই আল্লাহপাক শুনবেন, কেননা তিনি বলেছেন, সব ভাষাই তার সৃষ্ট এবং সব ভাষায়ই নবি-রাসূল পাঠিয়েছেন। তাই কোনো ভাষাই আল্লাহপাকের কাছে মর্যাদার দিক থেকে খাটো নয়। আর এ জন্য সবাই নিজ নিজ ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
কিন্তু বড় কষ্ট হয় তখন, যখন দেখি আমার প্রিয় মাতৃভাষার পরিবর্তে অন্য ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করতে। অথচ আল্লাহপাকের কাছে সব ভাষার মর্যাদা সমান। আমরা কি পারি না সর্বত্রে আমাদের দেশমাতৃকাকে প্রতিষ্ঠিত করতে?
আমাদের ওয়াজ-নসিহতগুলো হবে মাতৃভাষায়, আমাদের জুমার খুতবা হবে নিজ ভাষায়, নামাজে নির্ধারিত দোয়ার পর নিজ ভাষায় আল্লাহপাকের কাছে মন খুলে কিছু চাইতে কি পারি না? আল্লাহতায়ালাই তাওফিকদাতা।
লেখক- মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান, পাঠান পাড়া, (খান বাড়ী) কদমতলী, সদর, সিলেট-৩১১১, মোবাঃ ০১৯৬৩৬৭১৯১৭