কী বার্তা দিলেন মোদি ?

    0
    237

    আমারসিলেট টুয়েন্টিফোর ডটকম,০৮সেপ্টেম্বর,লুৎফুর রহমান তোফায়েলঃ ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী এমন সময় মিয়ানমার সফর করেছেন, যখন রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ সহিংসতা চলছে। দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী ও মৌলবাদী বৌদ্ধরা রোহিঙ্গাদের বসতবাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে, লুটতরাজ চালাচ্ছে। পথে-প্রান্তরে, নদীতে পাওয়া যাচ্ছে রোহিঙ্গাদের লাশ। সহিংসতায় এরই মধ্যে নিহত হয়েছে কমপক্ষে চার শতাধিক রোহিঙ্গা। তারা চাচ্ছে রোহিঙ্গাদের সে দেশ থেকে চিরতরে উৎখাত করে দিতে।

    গত বুধবার চট্টগ্রামের এক সংবাদিকের ফেইসবুক স্ট্যাটাসের উদ্ধৃতি দিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা ও বিজিবি জানিয়েছে, ‘রাখাইন সন্ত্রাসীরা ওখানে মাইকিং করে জানিয়েছে, ‘১২ তারিখের মধ্যে রোহিঙ্গাদের দেশ ছেড়ে যেতে। নইলে কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলবে।’ এক বিজিবি সদস্যকে জানান, ‘ওদের টার্গেট হচ্ছে ২০১৮ সালের মধ্যে পুরো রাখাইন রাজ্য রোহিঙ্গামুক্ত করা।’ এই অবস্থায় প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশ সীমান্তে নতুন করে রোহিঙ্গাদের ঢল নেমেছে। জাতিসংঘের হিসাবে, গত বুধবার পর্যন্ত এই দফায় প্রায় এক লাখ ৪৬ হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে।
    গত বুধবার বিবিসিতে প্রকাশিত এক সংবাদে দেখা যায়, মিয়ানমারের নির্যাতন থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গারা যাতে সেদেশে ফিরতে না পারে সেজন্যে মিয়ানমার সীমান্তে ল্যান্ড মাইন পেতে রাখা হচ্ছে বলে অভিযোগ ওঠেছে। গত তিন দিন ধরে বাংলাদেশ লাগোয়া সীমান্তের একাংশজুড়ে মাইন পেতে রাখার কাজ করছে মিয়ানমার। সীমান্তে পেতে রাখা এসব মাইন বিস্ফোরণে বাংলাদেশে পলায়নরত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের হতাহত হওয়ার কিছু খবরও পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশে নিযুক্ত মিয়ানমারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্টদূত অং মিন্টকে ডেকে এর প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ।

    গত বুধবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অনুবিভাগের মহাপরিচালক মঞ্জুরুল করীম তাকে তলব করে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনপ্রবেশের প্রতিবাদ জানান। এসময় অং মিন্টকে একটি অনানুষ্ঠানিক পত্র হস্তান্তর করা হয়। পত্রে মিয়ানমার সরকারকে রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা এবং বাংলাদেশে অবস্থানরত সব রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য জোরালো আহ্বান জানানো হয়।
    গত ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গাবিরোধী সহিংসতা শুরুর পর আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়ে মিয়ানমার। বিশেষ করে অং সান সু চির বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় বইছে। জাতিসংঘসহ বিশ্বের বড় বড় মানবাধিকার সংস্থা ও শক্তিশালী অনেক রাষ্ট্র মানবিক দিক বিবেচনায় রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিরুদ্ধে কথা বলছে। তাদের জন্য সহযোগিতার হাত প্রসারিত করছে। মিয়ানমার সরকারের ভূমিকার নিন্দা জানাচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক ফোরামে আলোচনা চলছে। সয়ং জাতিসংঘ প্রেসিডেন্ট এই বর্বরতার নিন্দা জানিয়েছেন। কিন্তু এই বর্বর হত্যাযজ্ঞ নিয়ে এতোদিন কোনো কথা বলেননি মিয়ানমারের সবচেয়ে বড় প্রতিবেশী ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি। তবে গত বুধবার মিয়ানমার সফরে গিয়ে সু চির পক্ষেই সাফাই গাইলেন তিনি।
    সু চির সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেন, শান্তির ক্ষেত্রে মিয়ানমারকে যে চ্যালেঞ্জগুলোর মুখে পড়তে হয়েছে, সে সম্পর্কে ভারত অবহিত রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভারত মিয়ানমারের পাশেই আছে এবং শান্তির জন্য যথাসম্ভব সাহায্য করবে। রাখাইন প্রদেশে সেনাবাহিনী ও সাধারণ মানুষের জীবনহানি নিয়ে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, মিয়ানমারের সার্বভৌমত্ব ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা বজায় রাখতে সব ধরণের সাহায্য করবে ভারত। সু চি’র সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বৈঠকের পর যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, বর্তমানের অশান্ত সময়ে মিয়ানমারের পাশেই থাকবে পুরোনো বন্ধু ভারত। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও রোহিঙ্গাদের গণহত্যার অভিযোগ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অবশ্য কোনো কথা বলেননি। নিপীড়িত রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়েও কোনো আহ্বান রাখেননি মোদি। এদিকে, মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি সন্ত্রাসবাদ প্রশ্নে ভারতকে পাশে পেয়ে সন্তোষ প্রকাশ করে ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
    মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সেদেশের সরকার যখন জুলুম, নির্যাতন ও গণহত্যা চালাচ্ছে তখন ভারতের পক্ষ থেকে দেয়া এই বক্ত্যকে ‘বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ’ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। যেখানে ভয়াবহ এই সহিংসতা থামাতে মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। কিন্তু সহিংসতা থামছে না। মিয়ানমারের দাবি, রাখাইনে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী বা জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাচ্ছে তারা। তাদের এ দাবির সঙ্গে বাস্তবের মিল নেই। শত শত বসতবাড়ি, মসজিদ-মাদরাসা জ্বালিয়ে দেওয়ার ছবি স্যাটেলাইটে ধরা পড়েছে বলে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।

    গতকাল বৃহস্পতিবার কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পে আসেন তুরস্কের এ ফার্স্ট লেডি এমিনি এরদোয়ান। এর আগে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের তীব্র নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান। তিনি একে ‘গণহত্যা’ বলেও উল্লেখ করেন। তিনি সু চির সঙ্গেও ফোনে কথা বলেছেন রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে। গত সপ্তাহে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদকে ফোন করে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ের ব্যাপারে বাংলাদেশকে সহায়তার অঙ্গীকার করেন।
    বিশ্ব নেতাদের এই অবস্থান, মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে একাধিকবার মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ, সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের নির্মমভাবে হত্যা, ধর্ষণ ও গণহত্যার মতো অভিযোগÑ এসব মিলে যখন অং সান সু চি সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক মহলের চাপ বাড়ছে, তখন মোদি যেভাবে সু চি ও মিয়ানমার সরকারের সাফাই গাইলেন, তাতে বিশ্ববাসীকে কী বার্তা দিলেন তিনি? নরেন্দ্র মোদির আশ্বাসে মিয়ানমার সরকার কি স্বস্তির নিঃস্বাস নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছে? মানবাধিকার লঙ্ঘনের চরম পর্যায়ে পৌঁছেও এই আশ্বাস কি মিয়ানমার সরকারকে সেদিকে আরও উদ্বুদ্ধ করবে না? এরই মধ্যে নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সুচির বৈঠক শেষে একটি বিবৃতি দেওয়া হয়েছে সু চির কার্যালয় থেকে। যাতে সু চি দাবি করেছেন, রাখাইন প্রদেশে যে সংকট চলছে, তা ভুল তথ্যের মাধ্যমে বিকৃত করা হচ্ছে। লেখক:প্রাবন্ধিক-কলামিস্ট