ফ্রান্সে বঙ্গবন্ধু স্কয়ার:নাদিম মাহমুদ

    0
    226
    আমারসিলেট24ডটকম,১৭জানুয়ারীঃ অনেক সংগ্রামী ব্যক্তি তাদের কর্ম ও দর্শনের মাধ্যমে নিজ অবয়বের বাইরে আরেকটি জীবনের অবতারনা করে গেছেন, যা তাঁদের প্রকৃত আয়ুষ্কালের তুলনায় অনেক দীর্ঘজীবী। আধিকার আদায়ের সংগ্রামে বজ্রহুঙ্কার দেয়া কণ্ঠের যেমন মৃত্যু নেই, তেমনি সে সংগ্রামের কুচকাওয়াজ চলে চক্ষুর আড়ালে অনন্তকাল। আর তেমনি এক সংগ্রামের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যার তেজোদ্দীপ্ত কণ্ঠের অনুরণিত স্বর তার অনন্ত উপস্থিতিরই জানান দেয় দেশপ্রেমীদের অন্তরে অন্তরে। ঢাকার রাজপথে যেমন স্যর জনসন আর রানী ভিক্টোরিয়ার নাম খচিত হয়েছে নানা কারণে আর তা চোখে দেখছে দুই বা তিন শতাব্দী পরের ভিন্ন এক প্রজন্ম। সন্দেহ নেই, তাতে তাদের ইতিহাস, কর্ম ও ঐতিহ্যের আলোই বিচ্ছুরিত হয়।
    আশ্চর্য হবার কিছু নেই যদি বাংলাদেশের ঐতিহ্য, বীরত্ব-গাঁথা সংগ্রামের ইতিহাস ও বজ্রমূষ্ঠষ্ঠিতে পরাধীনতার শৃঙ্খল ভাঙার গল্প আঁকা হয়ে যায় শিল্প-সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের দেশ ফ্রান্সের জনপদে; তাও মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে প্রতিকৃতি স্থাপন ও স্কয়ার ঘোষনার মাধ্যমে। দীর্ঘদিন যাবৎ চলছে সে উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা। আর এ প্রস্তাবনা সাফল্যের কাছাকাছি। বঙ্গবন্ধুর নামে নামকরণ করে স্কয়ার করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে পারে ল্য মনিয়াল মিউনিসিপেল।
    বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের নাম ফুটিয়ে তোলার এ অসাধারণ উদ্যোগকে স্বাগত জানানোর ভাষা আমাদের জানা নেই। পৃথিবীর ইতিহাসে সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিকাশে ফ্রান্সের ভুমিকা অনেক দিনের তা নতুন করে বলার মতো কিছু নেই। ইতিহাসে এই দেশটির মর্যাদা অনেক বেশী, এদেশের সরকার বা মানুষের ভিন্ন দেশের মানুষ বা ভিন্ন সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা ও গুরুত্বের কারণে। ফ্রান্সে বঙ্গবন্ধু স্কয়ার ও ভাস্কর্য ইতিহাসে নতুন এক মাত্রা তা কি বলার আর অপেক্ষা রাখে? আবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজ হাতে এই স্কয়ারের উদ্বোধন করবেন রচিত হবে নতুন ইতিহাসের, শুধু ফ্রান্স প্রবাসী নয় পুরো ইউরোপের বাংলাদেশীদের জন্য এর চেয়ে বড় সুসংবাদ আর কি হতে পারে!

    কে সেই উদ্যোক্তা?
    ফ্রান্সে বঙ্গবন্ধু স্কয়ার। অনেকেই এ খবরটি শুনে যেমন আনন্দিত হবেন ঠিক তেমনি বিস্মিত হবেন। আনন্দের কারণ বাংলাদেশের স্হপতি কে নিয়ে উন্নত দেশের বুকে স্কয়ার। বিস্মিত হবেন কারন এরকম একটি সাহসী দেশপ্রেমী ও মহৎ উদ্যোগ দেশের বাইরে কোথাও নেই এবং হচ্ছেও না। সবচেয়ে মজার বিষয়, অনেকের ধারণা; স্বাভাবিক ভাবে বঙ্গবন্ধু স্কয়ার মানেই আওয়ামীলীগ এর কোন প্রকল্প হবে হয়ত। তবে এখানে ব্যাপারটি সম্পূর্ণ উল্টো। ষাটের দশক বা তার কিছু আগে থেকে বাংলাদেশী বাঙালীরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জীবীকার তাগিদে পাড়ি জমিয়েছেন।

    উল্লেখযোগ্য একটি অংশ রয়ে গেছেন, তার পর থেকে, মিশে গেছেন সেসব দেশের সংস্কৃতি আর বেশভূষায়। অনেকে খেই হারিয়ে ভূলে গেছেন নিজ সংস্কৃতি আর হারিয়ে ফেলেছেন নিজ দেশের প্রতি মায়া। কিন্তু সত্যিকার দেশপ্রেমী নাগরিক পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুন না কেন, তার নিজ দেশের  ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির সুনাম তিনি ঠিকই কুড়িয়ে আনবেন। আর ঠিক তেমনি একজন দেশপ্রেমিক বাংলাদেশী নাগরিক বিশিষ্ঠ ব্যবসায়ী কাজী এনায়েত উল্লাহ। ব্যক্তিগত উদ্যোগে ফ্রান্সের পর্যটন নগরী পারে ল্য মনিয়াল-এ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষ্কর্য্য স্থাপনের জন্য নিজের সবটুকু দিয়ে দীর্ঘদীন যাবৎ এ স্বপ্নের বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন তিনি।

    রাজধানী প্যারিস থেকে প্রায় ৪০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এ শহরে বাংলাদেশের তথা বাংলাদেশী জনগণের সংগ্রামী ইতিহাসের পদচিহ্ন নিজ হাতে আঁকছেন এই দেশপ্রেমের শিল্পকার। সকল রাজনৈতিক মত, দলাদলি আর বিভাজনের উর্ধ্বে থেকে একতাবদ্ধ ষোল কোটি মানুষের প্রতিনিধি হয়ে উন্নত বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করে তোলার গুরুদায়িত্ব একা কাঁধে নেয়ার সাহস আর কারো হয়েছিল কি? আমরা শুনি নি। “নিছক দেশের প্রতি ভালবাসা, দেশের ইতিহাস কে আগামী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে স্থায়ীভাবে প্রজন্মের স্মৃতিতে রাখার জন্যই জাতির জনকের ভাস্কর্য স্থাপনের চেষ্টা করছি এবং বাস্তবায়নের দ্বারপ্রান্তে”- বললেন এই মহামুল্যবান প্রজেক্টের বাস্তবায়নকারি এই সাহসী পুরুষ।
    ডায়রীর পাতাঃ
    বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে বিদেশের মাটিতে এই প্রথম ভাস্কর্য স্থাপন ও স্কয়ারের নামকরণের মাধ্যমে বহিবিশ্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস, শিল্প -সাহিত্য কৃষ্টি-আরো সমৃদ্ধি লাভ করবে বলে হাস্যোজ্জ্বল মুখে দীপ্ত কণ্ঠে এনায়েত উল্লাহ বলেন, “এটি কোন রাজনৈতিক ইস্যু নয়, দেশের ইতিহাস ও ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার জন্যই ২০১১ সালের প্রথম দিকে পারে লূ  মনিয়ালের সিটি মেয়র  জঁ মার্ক নেমকে বাংলাদেশের ইতিহাস ঐতিহ্য শিল্প সংস্কৃতি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক জীবনী তুলে ধরে বঙ্গবন্ধুর নামে একটি সড়ক কিংবা স্কয়ারের নামকরণের জন্য প্রস্তাব করি।

    জাতির জনকের দেশপ্রেম ও বাংলাদেশের জন্মকথা শুনে মেয়র জঁ মার্ক নেম বিষয়টি আমলে নেন ও সিটি কাউন্সিলে বিষয়টি উত্থাপন করলে বঙ্গবন্ধু স্কয়ার স্থাপন বিলটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহিত হয়।” পরবর্তীতে এ বিষয়টি ২০১১ সালের ২০ ডিসেম্বর ফ্রান্স পার্লামেন্টে মেয়র জঁ মার্ক নেম সম্মেলন কক্ষে বঙ্গবন্ধু স্কয়ারের উদ্যোক্তা কাজী এনায়েত উল্লাহকে সাথে নিয়ে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক ভাবে বিষয়টি প্রকাশ করেন। যার স্মারক নং ৩৬০-সিএবিএম।

    তিনি গত ফেব্রুয়ারি  মাসে ফরাসী সাংবাদিক ফিলিপ আলফনসি কে সাথে নিয়ে ঢাকায় যান। এ সময় তার প্রযোজিত বাংলাদেশর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ের ভিডিও ফুটেজ নিয়ে প্রমান্যচিত্র ‘একটি পতাকার জন্ম’ জাতীয় জাদুঘরে প্রদর্শন  করেন। সেই সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাৎ হয়। তখন কাজী এনায়েত উল্লাহ প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানী উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধরী ও সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের সাথে বঙ্গবন্ধু স্কয়ারের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন।

    এরই প্রেক্ষিতে ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধরী ও আসাদুজ্জামান নুর বিষয়টিতে বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করে সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতার আশ্বাস প্রদান করেন।
    গত ২৯ এপ্রিল মঙ্গলবার বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশে ফ্রান্সে নিযুক্ত বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রদূত এম শহিদুল ইসলাম সরেজমিনে পারে ল্য মনিয়াল শহর পরিদর্শন করেন। সেখানে তিনি পারে ল্য মনিয়াল এর সিটি মেয়র জনমার্ক নেমের সাথে সাক্ষাত করে পরবর্তী পদক্ষেপের ব্যাপারে  বিস্তারিত আলোচনা করেন ।

    ৩০ এপ্রিল বুধবার পারে লে মনিয়ালের সিটি মেয়র জনমার্ক নেম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য স্থাপন ও বঙ্গবন্ধু স্কয়ারের স্থান নির্ধারনের জন্য কাজী এনায়েত উল্লাহকে আমন্ত্রণ জানান। ঐ দিন কাজী এনায়েত উল্লাহ একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে পারে ল্য মনিয়াল শহরে যান। এ সময় মেয়র প্রতিনিধি দল নিয়ে শহরের কয়েটি উল্লেখ্যযোগ্য স্থান সরেজমিনে ঘুরে দেখান।

    এ সময় শহরের প্রান কেন্দ্র  একাদশ শতাব্দিতে নির্মিত বাজিলিকের পার্শ্বে সবুজ শ্যামল মনোরম এক পরিবেশে বঙ্গবন্ধু স্কয়ারের স্থান নির্ধারন ও সেখানে  ভাস্কর্য স্থাপনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়। পরে মেয়র তার অফিস কক্ষে ভাস্কর্য স্থাপন ও বঙ্গবন্ধু স্কয়ার উদ্বোধন করার জন্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রন জানিয়ে একটি আমন্ত্রণপত্র তুলে দেন প্রতিনিধি দলের প্রধান কাজী এনায়েত উল্লাহর হাতে।
    আমরা কি যোগ দিতে পারি?
    সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের দিক থেকে ধনী জাতির জন্য পৃথিবীর বুকে নেতৃত্ব দেয়া চিরদিনই সহজ ছিল। তার প্রমান যেমন রোমান, গ্রীক আর ইংরেজরা রেখে গেছে বহু আগে। তেমনি উন্নত ঐতিহ্যের জাতি হিসেবে আমাদের পদচিহ্ন ইউরোপে আঁকতে পারলে আজ যে আনন্দ কাজী এনায়েত উল্লাহ পাবেন, তা নিঃসন্দেহে আমাদেরও আনন্দ। ফ্রান্সের মতো দেশে বঙ্গবন্ধুর নামে ভাস্কর্য স্থাপিত হওয়ার বিষয়টি অবশ্যই গৌরবের। এ রকম একটি কাজ বাস্তবায়ন করা প্রতিটি বাংলাদেশীর জন্যই স্বপ্নের মতো। সেই স্বপ্নের বাস্তবায়নে আমাদের যে কারো যোগ দিতে ইচ্ছে করবে। নিঃসন্দেহে এর সিংহভাগ কাজী এনায়েত উল্লাহ একাই করে ফেলেছেন। আর যেটুকু তিনি আমাদের হাতে অর্পণ করেছেন সেটুকু আমরা করতে পারলে ধন্য হব বৈ কি।

    এ স্বপ্ন দেখার অধিকার আর বাস্তবায়ন ও ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহন করে নিজ নিজ দেশপ্রেমের পরিচয় দেয়ার দায়িত্ব আমাদের সবার রয়ে গেছে। আমরাও পারি, জনাব কাজী এনায়েত উল্লাহ’র সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একটি বাংলাদেশকে বিশ্বের দরবারে মর্যাদার আসনে আসীন করতে। লাল-সবুজের পতাকা তাই বিজয়ীর বেশে উড়ে বহমান বাতাসের স্রোতে স্রোতে জানান দিচ্ছে আমাদের উপস্থিতির কথা।

    আমরা দেশপ্রেমীরা একত্র হয়েছি , আমরাও চাই আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের লাখো প্রাণের বিনিময়ে এনে দেয়া দেশকে সর্বোচ্চ মর্যাদা সম্মানের অধিকারী করতে। জাতি হিসেবে আমাদের গৌরব আর অহঙ্কারের ইতিহাস জানুক মহাদেশ থেকে মহাদেশে, আর প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে।
    আমাদের দায়িত্ব কি?
    একটি জাতির শান্তি ও সমৃদ্ধি বাস করে একতা, উদারতা ও ন্যায়-পরায়নতার মাঝে। কাজী এনায়েত উল্লাহ যেমন কোন রাজনৈতিক দলের হয়ে নয়, নিজ উদ্যোগে এ প্রকল্প চালিয়ে যাচ্ছেন; আমাদেরও উচিৎ এ প্রকল্পটিকে আমাদের একতার প্রতীক হিসেবে মূল্যায়ন করা। দল, মত, ধর্ম বা বংশের ভিত্তিতে বিভাজন তৈরী করে কেউ দেশপ্রেম ও সততার পরিচয় দিতে পারে না। উপরন্তু তা আমাদের শান্তি ও ঐক্য বিনষ্ট করে অশান্তি তৈরী করবে নিশ্চিত। ফলস্বরুপ, আমাদের দেশপ্রেমের অর্জন ধূলিস্যাৎ হয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের বদনাম ছড়িয়ে পড়বে।

    ফ্রান্সের বুকে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ও তাঁর নামে স্কয়ার কোনো রাজনৈতিক দলের নিজস্ব অর্জন নয়। এ প্রকল্পের নায়ক কাজী এনায়েত উল্লাহর পক্ষ থেকে আমাদের সমগ্র বাংলাদেশের মানুষের জন্য এটি একটি উপহার মনে করি। আমাদের উচিত দল, মত ও অন্যান্য বিভাজক সঙ্কীর্ণতার বাইরে এসে এ মহান প্রকল্পের উদ্যোগ গ্রহন ও বাস্তবায়নের জন্য তার শ্রম ও দেশপ্রেমের সঠিক মূল্যায়ন ও সম্মান প্রদর্শন করা।
    কাজী এনায়েত উল্লাহ একাধারে  ফ্রান্স বাংলাদেশ চেম্বার অফ ইকোনমির সভাপতি, বাংলাদেশ বিজনেস কনসাল্টিং এর চেয়ারম্যান, অল ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ এসোসিয়েশন (আয়েবার) মহাসচিব, এবং বনানী গ্রুপের চেয়ারম্যান।