বর্ষার আগমনী বার্তায় আত্রাইয়ে নৌকা তৈরির ধুম পড়েছে

0
112

নাজমুল হক নাহিদ, আত্রাই (নওগাঁ) প্রতিনিধি: উত্তর জনপদের মৎস্য ভান্ডার খ্যাত নওগাঁর আত্রাইয়ে বর্ষার আগমনী বার্তার সাথে সাথে নৌকা তৈরির ধুমপড়েছে।
গত কয়েক দিনে নওগাঁর আত্রাই নদীতে পানি বাড়ার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নৌকা তৈরি। উপজেলার বিভিন্ন হাটে এখন তৈরি নৌকা বিক্রি হচ্ছে। নৌকা তৈরিকে ঘিরে ব্যস্ত সময় পাড় করছেন কাঠমিস্ত্রি ও কারিগররা।
নতুন নৌকা তৈরির পাশাপাশি পুরাতন নৌকা মেরামতের কাজও করছেন তারা।

৮টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত আত্রাই উপজেলা। এ উপজেলায় বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষের বসবাস। বর্ষা মৌসুমে এ উপজেলার জেলে সম্প্রদায়ের লোকেরা মাছ ধরার কাজে ব্যস্ত সময় পার করেন।

বর্ষা মৌসুমকে সামনে রেখে নৌকা তৈরির কাঠ মিস্ত্রি ব্যস্ত হয়ে পড়েন। দিনরাত কাঠ চিরানো, তক্তা ও গুড়া বানানো, রান্দা দিয়ে কাঠ মসৃণ করা, তারকাঁটা (ছোট লোহা) ও পাতাম (লোহার পাত) দিয়ে তক্তা জোড়া লাগানো ইত্যাদি কাজে ব্যস্ত সময় পাড় করছেন কাঠ মিস্ত্রিরা। এসব কাজগুলো তারা বাড়ি বা পাড়ায় কিংবা নৌকার হাটগুলোর কাছাকাছি স্থানে করে থাকেন।

নৌকা তৈরির মৌসুমী কাঠ মিস্ত্রিরা বর্ষা মৌসুম ব্যতিত সময়গুলোতে বাড়ির পারিবারিক কাজ ও কৃষি কাজ করে থাকেন। আবার পেশাদার কাঠ মিস্ত্রিরা সারা বছর নৌকা তৈরি ছাড়াও ঘর, খাট, চেয়ার, টেবিল, ড্রেসিং টেবিল, আলনা, আলমারি ইত্যাদি গৃহস্থালী তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকেন।

সরেজমিনে উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, কাঠ মিস্ত্রিরা কেউ বাড়ির আঙিনায় বা পাড়ার খালি জায়গায়, কেউ কেউ হাটের পাশে নৌকা তৈরি করছেন। কেউ কাঠ চিরাচ্ছেন, কেউ তক্তা ও গুড়া বানাচ্ছেন, আবার কেউ রান্দা দিয়ে কাঠ মসৃণ করছেন, কেউ কেউ তারকাঁটা (ছোট লোহা) ও পাতাম (লোহার পাত) দিয়ে তক্তা জোড়া লাগাচ্ছেন। এসব কাজে সহযোগিতা করছেন পরিবারের লোকজন।

কাঠ মিস্ত্রি অজিত সূত্রধর, উৎপল সূত্রধর, নিরেন সূত্রধর, অখিল চন্দ্র সূত্রধরসহ অনেকেই বলেন, এখন প্রায় প্রত্যেক এলাকায় যোগাযোগের জন্য রাস্তা করা হয়েছে। ফলে দূরের যাত্রার জন্য কেউ বড় নৌকা তৈরি করে না। বর্ষায় এ পাড়া থেকে ওপাড়া যাতায়াতের জন্য ছোট ছোট নৌকার প্রয়োজন হয়। তাই বড় নৌকা তৈরি হয় না- ছোট নৌকার কদর বেশি। এক সময় এ পেশা তাদেরই ছিল। এখন অনেক এলাকায় মুসলমানরাও এ পেশায় এসে তাদের সুনাম ক্ষুন্ন করছে ও চাহিদা কমে গেছে।

তারা আরও বলেন, বর্ষা মৌসুমে কাঠ মিস্ত্রির কাজ করেই তাদের সংসার চলে। ছোট সময় থেকে বাপ-দাদার কাছে হাতেখড়ি নিয়েছেন তারা। কাঠ মিস্ত্রির কাজ করা তাদের নেশা ও পেশা। একটি নৌকা তৈরিতে তিনজনের ২-৩দিন সময় লাগে।

ভবানীপুর গ্রামের নিরেন চন্দ্র সূত্রধর বলেন, ‘আমি কাঠের বিভিন্ন আসবাবপত্র তৈরির পাশাপাশি নতুন নৌকা তৈরি ও পুরাতন নৌকা মেরামতের কাজ করছি। আমার সাথে আরও দুইজন কাজ করছেন। তারাও ব্যস্ত সময় পাড় করছেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘দীর্ঘ ৫৫ বছরের বেশি সময় ধরে আমি কাঠ মিস্ত্রির কাজ করছি। ছোটবেলায় হাতুড়ি ও বাটালের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। আমাদের সময় পড়াশোনার খরচ অনেক বেশি ছিল। সংসার চালানোই যেখানে দায়- সেখানে লেখাপড়ার প্রশ্নটা অবান্তর ছিল। বাপ-দাদারা বলেছেন, কাঠ মিস্ত্রির কাজ করেই পেট চালাতে হবে। তাই বাপ-দাদার সাথে কাঠ মিস্ত্রির কাজ শিখেছি। মুরব্বিদের সাথে বাসাইল উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে কাজ করছি। এখন বর্ষার সময় হলে নৌকা তৈরি করছি। শুকনো মৌসুমে ঘর, খাট, চেয়ার, টেবিল ড্রেসিং টেবিল, আলনা, আলমারি ইত্যাদি তৈরি করে হাটে বিক্রি করে সংসার চলে।’

অজিত চন্দ্র সূত্রধর বলেন, ‘বর্ষা মৌসুমে নৌকার কদর বেড়ে যায়। তাই বর্ষার সময় নৌকা তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। বাপ-দাদারা শিখিয়ে যাওয়া কাজ এখন আমাদের নেশা ও পেশা হয়ে গেছে। একটি ছোট নৌকা তৈরি করতে ২-৩ দিন সময় ও ৮ থেকে ১৮ হাজার টাকা খরচ হয়। হাটে ওঠালে একটি ছোট নৌকা ১০ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করা যায়।’

সমসপাড়া হাটে নৌকা বিক্রি করতে আসা উপজেলার পারমহোনঘোষ গ্রামের আব্দুল লতিফ, ফেকু, আব্দুল মজিদসহ অনেকে বলেন, ‘আমরা কৃষক মানুষ। বর্ষায় আমাদের মাঠ ডুবে যাওয়ায় আমরা কর্মহীন হয়ে পড়েছি। বর্তমানে বিভিন্ন গ্রামে নৌকার চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় আমরা নৌকা বিক্রির পেশায় নিয়োজিত হয়েছি। শুধু আত্রাই নয় রাণীনগর, নাটোরের সিংড়া এবং চলনবিল এলাকার লোকজনও আমাদের নৌকা ক্রয় করতে আসেন।’

তারা জানান, বর্তমানে কাঠ-বাঁশের দাম বেশি এবং মিস্ত্রী মজুরি বেশি হওয়ায় খুব বেশি লাভ না হলেও যা হয়, তা দিয়ে সংসারের হাট-বাজার করা যায়।

কাঠ মিস্ত্রি অখিল চন্দ্র সূত্রধর বলেন, ‘শিশুকালে হাতুড়ি-বাটালের সঙ্গে বড় হয়েছি। লেখাপড়া করেনি। পূর্বপুরুষের পেশাকেই মূল পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছি। বউ বাচ্চা নিয়ে মোটামুটি ভালোই চলে যায়। চুক্তিতে বায়নায় নৌকা তৈরি করা হয়। এতে প্রতিদিন ৭০০ থেকে এক হাজার টাকা মজুরি পাই। বর্ষার সময় এলে আয় রোজগার ভালোই হয়। শুকনো মৌসুমে সংসারের টুকিটাকি আর কৃষি কাজ করি।’ তিনি এই পেশায় প্রায় ৩৫ বছর ধরে তিনি এ পেশার সাথে রয়েছেন।