মিয়ানমারের সেনাপ্রধানকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর তাগিত

    0
    397

    আমারসিলেট টুয়েন্টিফোর ডটকম,২৭অক্টোবর,ডেস্ক নিউজঃ    রোহিঙ্গা সংকট নিরসনের জন্য যথেষ্ট চাপের মুখে পড়েছে মিয়ানমার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দেশটির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। মিয়ানমারের সেনা কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এবার রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে ভারত ও চীনের সক্রিয় তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বড় দুই শক্তি অবশ্য দেশটির বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগের পরিবর্তে নিজস্ব উপায়ে দ্বিপক্ষীয়ভাবে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছে। সংকট নিরসনের লক্ষ্যে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয়ভাবে কাজ করছে ভারত। অপরদিকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীন কোনো পক্ষপাতমূলক অবস্থান নিচ্ছে না। তাদের (চীনের) কাছে উভয় দেশেরই গুরুত্ব রয়েছে। রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে চীন উদ্বিগ্ন। কূটনৈতিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
    চীনের একজন বিশেষ দূত বুধবার ঢাকায় পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হকের সঙ্গে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বৈঠক করেছেন। বৈঠক শেষে পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে চীন উদ্বিগ্ন। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার দ্বিপক্ষীয়ভাবে সংকট নিরসন করুক এটাই চায় চীন। এ বৈঠকে চীনের দূত জানান, রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীন কোনো পক্ষপাতমূলক অবস্থান নেবে না। চীনের কাছে উভয় দেশেরই গুরুত্ব রয়েছে। অপরদিকে ঢাকায় নিযুক্ত ওইসিডি ও ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতদের রোহিঙ্গা পরিস্থিতি অবহিত করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বৈঠক শেষে মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট বলেছেন, শান্তি ও স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের স্বার্থে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশগুলোর ভূমিকা পালন করতে হবে। তবে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে মিয়ানমার কোনো সাড়া না দিলে দেশটির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার কথা যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর ভাবছে বলে জানান বার্নিকাট।
    বুধবার ঢাকায় একটি কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের বাংলাদেশ সফরকালে রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে। সফরের সময় সুষমা স্বরাজ জানিয়েছেন, রাখাইন পরিস্থিতি নিয়ে ভারত গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। কেননা এই পরিস্থিতির ফলে ১০ লাখের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। ভারত এসব রোহিঙ্গাদের টেকসই উপায়ে রাখাইন রাজ্যে ফেরত পাঠানোর প্রতি জোর দিয়েছে। বিশেষ করে রাখাইন রাজ্যে ফিরে গিয়ে তারা যাতে নিরাপদে বসবাস করতে পারেন সেই বিষয়টি নিশ্চিত করতে চাইছে। একই সঙ্গে রোহিঙ্গা সংকটের কারণে বাংলাদেশ যে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে তা নিরসনে মানবিক ত্রাণ নিয়ে ‘অপারেশন ইনসানিয়াত’ পরিচালনা করেছে ভারত। ভারত ইতিমধ্যে ৯২ হাজার ফ্যামিলি প্যাক খাদ্যসামগ্রী বিতরণ করেছে।

    জানতে চাইলে ঢাকায় ভারতীয় কূটনৈতিক সূত্রটি আরও জানায়, ‘আমরা মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পৃক্ত আছি। তবে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগের কোনো দৃষ্টিভঙ্গি দেখালে তার ফল খারাপ হতে পারে। আমরা মিয়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোসহ সংকটের সার্বিক সমাধানের জন্য দ্বিপক্ষীয়ভাবে যুক্ত আছি। আমাদের এ সম্পৃক্ততা অব্যাহত থাকবে। পাশাপাশি রাখাইনে আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে প্রকল্প গ্রহণে আমরা আগ্রহী। রোহিঙ্গাসহ সব সম্প্রদায়কে সেখানে বসবাসের উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে এটা জরুরি।’ এক প্রশ্নের জবাবে সূত্রটি জানায়, ‘রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশাপাশি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গেও আলোচনা হয়েছে। খালেদা জিয়া রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারতের ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। তিনি ভারতের উদ্যোগকে সমর্থন করেছেন।’

    এদিকে, রোহিঙ্গা বিষয়ে আলোচনা করতে চীনের এশিয়া বিষয়ক বিশেষ দূত সুন গোসিয়াং বুধবার ভোরে এক দিনের সফরে ঢাকায় আসেন। তিনি বিকালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হকের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। গুসিয়াংয়ের রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে এটি দ্বিতীয়বারের মতো বাংলাদেশ সফর। ইতিপূর্বে এপ্রিলেও তিনি বাংলাদেশ সফর করেছিলেন।

    সুন গোসিয়াং মিয়ানমারে শান্তি প্রক্রিয়া নিয়েও কাজ করে থাকেন। মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি ক্ষমতায় গিয়ে দেশটিতে জাতিগত সংহতি প্রতিষ্ঠায় পালং সম্মেলন করেছেন। মিয়ানমারে সংখ্যাগরিষ্ঠ বর্মী সম্প্রদায়ের বাইরে ১৩৫টি জাতি গোষ্ঠী রয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ বর্মীরা চান তারাই মিয়ানমারে প্রভাব বিস্তার করে থাকবেন। এ নিয়ে জাতিগত সংখ্যালঘুদের মধ্যে নানা বিদ্রোহী গ্রুপ সৃষ্টি হয়েছে। তাদের মধ্যে চীন সীমান্ত এলাকাতেও একটি বিদ্রোহী গ্রুপ রয়েছে। ওই সীমান্তে মিয়ানমার যাতে সংখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিত করে তা নিয়ে কাজ করেন সুন গোসিয়াং। মিয়ানমারে রোহিঙ্গারা ১৩৫টি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাইরে। কেননা রোহিঙ্গাদের কোনো নাগরিকত্ব নেই। ফলে জাতিগত সংহতি উদ্যোগে তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

    সুন গোসিয়াং এপ্রিলে বাংলাদেশ সফরকালে পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হকের সঙ্গে বৈঠকে রোহিঙ্গা সংকট আন্তর্জাতিক অঙ্গনে না নেয়ার অনুরোধ করেছিলেন। তারপর ২৫ আগস্ট থেকে রোহিঙ্গাদের বড় ধরনের ঢল বাংলাদেশে ঢুকতে শুরু করায় বিষয়টির প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি পড়ে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে চীন ও রাশিয়ার সম্ভাব্য ভেটো দেয়ার আশঙ্কায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে নিরাপত্তা পরিষদ কোনো শান্তিমূলক পদক্ষেপ নিতে পারেনি।

    বৈঠকের পর পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমরা আমাদের অবস্থান তুলে ধরেছি। এর আগে উনি এসছিলেন, ৬ মাস আগে। আমি তাকে বলেছি, ৬ মাস আগে তুমি যখন এসেছিলে, তখন চার লাখ ছিল। এখন এক মিলিয়ন হয়েছে। এটি হল বাস্তবতা।’

    পররাষ্ট্র সচিব আরও বলেন, ‘সে বলেছে, তাদের ফিরিয়ে নেয়ার যে ইনটেনশন, যে কমিটমেন্ট, সেটি আগের থেকে স্ট্রংগার। আমরা বলেছি, সেটি যখন ঘটবে, তখন দেখব। কিন্তু আমরা কিছু ইতিবাচক চিহ্ন দেখছি।

    তিনি আরও বলেন, ‘আমি বলেছি এটি আমাদের ওপর বিরাট বোঝা। মানবিক কারণে আমাদের প্রধানমন্ত্রী তাদের থাকতে দিয়েছেন। কিন্তু এটি দীর্ঘায়িত হতে পারে না। চীন বলেছে, মিয়ানমারও তাদের বন্ধু, বাংলাদেশও তাদের বন্ধু। দুই বন্ধুর সঙ্গে কাজ করে তারা শান্তিপূর্ণ সমাধান করতে চায়।’

    মিয়ানমার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে আছে কিনা জানতে চাইলে সচিব বলেন, ‘এটি তো আমি বলতে পারব না’। চীন মধ্যস্থতা করবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মধ্যস্থতা করার প্রশ্ন এখনও আসেনি। তারা চাচ্ছে শান্তিপূর্ণভাবে এটি যেন সমাধান হয়ে যায়। আমরা তো মিয়ানমারের সঙ্গে কথা বলছি।’

    চীনের কোনো নতুন বার্তা আছে কিনা জানতে চাইলে মো. শহীদুল হক বলেন, ‘তারা উদ্বিগ্ন। এ ঘটনা এ এলাকার জন্য, এশিয়ার জন্য ভালো নয়, এটি বোঝা যাচ্ছে। তা নইলে তিনি এভাবে সফর করতেন না।’

    পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে বৈঠকের পর সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেছেন, ‘চীনের বিশেষ দূত বলেছেন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয়েই চীনের বন্ধু। উভয় দেশই চীনের কৌশলগত অংশীদার। চীন কোনো পক্ষেই যাবে না। বাংলাদেশ ও মিয়ানমার রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে দ্বিপক্ষীয়ভাবে যুক্ত হওয়াকে চীন স্বাগত জানায়। তবে চীনের নীতি হল কারও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা। ফলে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার মিলে এ সংকট সমাধানে সমর্থ হবে বলে আশা করি।’

    জানতে চাইলে ঢাকায় চীনের দূতাবাসের একজন কূটনীতিক বুধবার যুগান্তরকে বলেছেন, ‘চীন রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে বাধা দিলে এ ইস্যু নিরাপত্তা পরিষদে উঠল কিভাবে? আমরা আমাদের পথে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে ভূমিকা পালন করছি। কিন্তু বাংলাদেশে কোনো পক্ষ চীনের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করতে চীন রোহিঙ্গা সংকট নিরসনের বিপক্ষে বলে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে।’

    অপরদিকে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বুধবার ৩৫ দেশের জোট ‘দ্য অর্গানাইজেশন ফল ইকোনমিক কো অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ (ওইসিডি) এবং ব্রাজিল, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার সমন্বয়ে গঠিত ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক। সেখানে রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমারের নিষ্ঠুর দমন-পীড়নের কথা অভিযোগ করা হয়। বৈঠকের পর মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট সাংবাদিকদের বলেন, ‘এ অঞ্চলের শান্তি, স্থিতিশীলতা ও উন্নয়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের প্রতিবেশী দেশগুলোর রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে প্রচেষ্টা চালানো উচিত’। চীন ও ভারতের ভূমিকা সম্পর্কিত এক প্রশ্নের উত্তরে মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেন, ‘রোহিঙ্গা ইস্যুতে এ দু’দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বড় কোনো মতপার্থক্য নেই। তারাও রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান চায়। আমরাও এ সংকটের সমাধান চাই।’ মার্কিন রাষ্ট্রদূত রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয়ভাবে বাংলাদেশে যুক্ত থাকার প্রশংসা করেন। তবে তিনি হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন যে, সংকট নিরসনে মিয়ানমার সাড়া না দিলে দেশটির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার কথা ভাবছে যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র দফতর। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর মিয়ানমারের বিরুদ্ধে সামরিক সহায়তা স্থগিত, নিপীড়নকারীদের বিচারের আহ্বান এবং মিয়ানমারের ওপর গ্লোবাল ম্যাগনিটস্কি আইন প্রয়োগের হুমকি দিয়েছে। রাখাইনে গণহত্যার বিরুদ্ধেও যুক্তরাষ্ট্র পদক্ষেপ নেবে।সুত্রঃযুগান্তর