স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জেলা পরিষদ নির্বাচন ও জনপ্রত্যাশা

    0
    239

    আমারসিলেট টুয়েন্টিফোর ডটকম,২১নভেম্বরঃ আমরা আনন্দিত যে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো জেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। আমাদের সংবিধানের ৫৯ অনুচ্ছেদে যদিও সুস্পষ্টভাবে বলা আছে যে, প্রশাসনের সব স্তরে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হবে, তা সত্ত্বেও গত ৪৪ বছরে কোনো সরকারই জেলা পর্যায়ে নির্বাচিত স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করতে এগিয়ে আসেনি। সুতরাং আমাদের প্রত্যেক সরকারই সংবিধান লংঘন করেছে। শুধু তাই নয়, ১৯৯২ সালে জেলা পরিষদ নির্বাচন বাতিল সংক্রান্ত কুদরত-ই-এলাহী পনির মামলার রায়ে সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ সুস্পষ্টভাবে নির্দেশনা দিয়েছিলেন যে, ৬ মাসের মধ্যে প্রত্যেক স্থানীয় সরকারের নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু আজ ২৪ বছর পরও এটি বাস্তবায়িত হয়নি। তবে আশার কথা এই যে, বর্তমান সরকার বহু টালবাহানার পর শেষ পর্যন্ত জেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নিয়েছে। যদিও ২০০০ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জেলা পরিষদ আইন প্রণীত হয়, তবুও নির্বাচনের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি বরং ২০১১ সালের ডিসেম্বর মাসে আওয়ামী লীগ এবং তার সহযোগী সংগঠনের নেতাদের জেলা পরিষদের প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। যাই হোক, জেলা পরিষদ নির্বাচন হচ্ছে এটা অবশ্যই আনন্দের বিষয়।

    কিন্তু জেলা পরিষদ নির্বাচন কেন? জেলা পরিষদ নির্বাচনের মূল লক্ষ্য হল- আমাদের সাংবিধানিক আকাক্সক্ষা অনুযায়ী রাষ্ট্রে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা। গণতন্ত্র মানে সর্বস্তরে গণপ্রতিনিধিদের শাসন। কেন্দ্রে যেমন নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সরকার গঠন করবে, ঠিক তেমনিভাবে জেলায় নির্বাচিত জেলা পরিষদ, উপজেলায় নির্বাচিত উপজেলা পরিষদ, ইউনিয়নে নির্বাচিত ইউনিয়ন পরিষদ, সিটি কর্পোরেশনে নির্বাচিত সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভায় নির্বাচিত পৌরসভার প্রতিনিধিরা শাসনকার্য পরিচালনা করবেন- এটাই আমাদের সাংবিধানিক আকাক্সক্ষা। অর্থাৎ সত্যিকারের জনপ্রতিনিধিরা, যারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে আসেন, তারা যদি এসব প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা পরিচালনা করেন তাহলেই তা সাংবিধানিক নির্দেশনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।
    কিন্তু আমরা গণমাধ্যমের সুবাদে যতটুকু জেনেছি তাতে যেভাবে জেলা পরিষদ নির্বাচন হবে সেটা সত্যিকারের গণতান্ত্রিক হবে কিনা এবং সেটা সত্যিকার অর্থেই আমাদের সাংবিধানিক নির্দেশনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে কিনা- তা নিয়ে আমাদের মনে সংশয়ের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। আমরা যতটুকু জেনেছি, জেলা পরিষদের একদল প্রতিনিধি (একজন চেয়ারম্যান, ১৫ জন সদস্য ও পাঁচজন সংরক্ষিত সদস্য) নির্বাচিত ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভার নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হবেন। যদিও এটা মন্দের ভালো, তবে এটা অনেকটা আইয়ুব খানের মৌলিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মতো। উত্তম হতো যদি জেলা পরিষদ যারা পরিচালনা করবেন, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান থেকে আরম্ভ করে জেলা পরিষদের অন্যান্য প্রতিনিধি, তারা যদি জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হয়ে আসতেন। তবে হ্যাঁ, জেলা একটি বড় এলাকা। অনেক জেলা আছে বেশ বড়। যেখানে এটা খুব সহজে করা সম্ভব নয়। অর্থাৎ বড় জেলায় প্রত্যক্ষভাবে ভোট অনুষ্ঠান করা দুরূহ হবে এবং এটা ব্যয়সাপেক্ষও হবে।
    তবুও এর বিকল্প কিছু ভাবা যেতে পারে। একটা হতে পারে প্রতিটি জেলাকে একাধিক ওয়ার্ডে ভাগ করে নেয়া। একাধিক ওয়ার্ডে ভাগ করে প্রত্যেক ওয়ার্ড থেকে জনগণের সরাসরি ভোটে জেলা পরিষদের প্রতিনিধি নির্বাচন করা। এর মাধ্যমে যারা প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হবেন তারা জনগণের সরাসরি সম্মতিতে জেলা পরিষদ পরিচালনা করবেন বা দায়িত্বপ্রাপ্ত হবেন। বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে যারা প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হয়ে আসবেন তারা নিজেরা মিলে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, জেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান এবং অন্যান্য ব্যক্তিকে- যারা জেলা পরিষদের কার্যক্রম পরিচালনা করবেন- নির্বাচিত করবেন। এতে করে জনগণের সরাসরি ভোট দেয়ার একটা সুযোগ সৃষ্টি হবে। জনগণের সরাসরি ভোট দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হলে অপেক্ষাকৃত ভালো ব্যক্তিদের নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেবে।
    যেসব জেলায় অপেক্ষাকৃত ভালো ব্যক্তিরা নির্বাচিত হবেন সেখানে জেলা পরিষদ ভালো চলবে এবং এর মাধ্যমে জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত হবে। এর আরেকটি আকর্ষণীয় দিক হল, এ ধরনের নির্বাচন পদ্ধতিতে যারা বিভিন্ন ওয়ার্ড থেকে প্রতিনিধি হয়ে আসবেন তারা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হওয়ার মতো যোগ্যতাসম্পন্ন হবেন। যেহেতু যে কোনো ওয়ার্ড থেকে যে কোনো নির্বাচিত ব্যক্তির এ পদ্ধতিতে চেয়ারম্যান হওয়া সম্ভব, তাই প্রত্যেক ওয়ার্ড থেকে যারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন আশা করা যায় তারা অপেক্ষাকৃত অধিক যোগ্যতাসম্পন্ন হবেন। এর ফলে জেলা পরিষদে নির্বাচিতদের যোগ্যতার মান অনেক বেশি হবে। একই সঙ্গে আরেক দিক থেকেও এটা আমাদের জন্য আকর্ষণীয় হবে। এ প্রক্রিয়ায় জাতীয় পর্যায়ের মতো একটি পার্লামেন্টারি সিস্টেম চালু হবে। কিন্তু আমাদের অনেক স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানেই একটি প্রেসিডেন্সিয়াল সিস্টেম চালু আছে। সেখানে সরাসরি চেয়ারম্যান ও মেয়ররা নির্বাচিত হয়ে আসেন। কিন্তু আমাদের প্রস্তাবিত এ নির্বাচন পদ্ধতির মাধ্যমে জাতীয় সরকারের মতো একই পদ্ধতি স্থানীয় পর্যায়েও প্রতিষ্ঠিত হবে। তবে এখানে একটি ঝুঁকির আশংকাও রয়েছে। ঝুঁকিটা হল, এখানে যেহেতু মাত্র কয়েকজন প্রতিনিধির ভোটে জেলা পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা অর্থাৎ চেয়ারম্যান বা অন্যান্য পদের ব্যক্তিরা নির্বাচিত হবেন, সেখানে প্রতিনিধি কেনাবেচার একটা আশংকা থেকেই যাবে। এ ব্যাপারে আমাদের অভিজ্ঞতা ভালো নয়।
    পাকিস্তান আমলে কেন্দ্রীয় পর্যায়ে দেখেছি, সকাল বেলা একজন প্রধানমন্ত্রী আবার বিকালেই আরেকজন প্রধানমন্ত্রী। সংসদ সদস্যদের কেনাবেচার মাধ্যমে এটা ঘটেছে। তখন অবশ্য ফ্লোর ক্রসিংয়ের ওপর বিধিনিষেধ ছিল না। এক দলের পক্ষে নির্বাচিত হয়ে আরেক দলের পক্ষে ভোট দেয়া সম্ভব ছিল – যেটাকে পরবর্তী সময়ে আমাদের সংবিধানে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সম্প্রতি আমরা পশ্চিমবঙ্গে দেখেছি, তৃণমূল কংগ্রেস বেশ কয়েকটি জায়গায় বামপন্থী ও কংগ্রেসের মনোনয়নে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ভাগিয়ে এনে জেলা পরিষদ দখল করেছে। এ ধরনের দখলদারিত্ব একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। শুধু তাই নয়, এটি পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়াকেই কলুষিত করে ফেলতে পারে। এ ধরনের ব্যবস্থা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। তবুও বলব, আমাদের প্রস্তাবিত পদ্ধতিই অপেক্ষাকৃত ভালো হবে। তবে নিশ্চিত করতে হবে, কেনাবেচার বিষয়টি যেন না আসে এবং অস্থিতিশীল অবস্থার সৃষ্টি না হয়।
    এবার উপজেলা নির্বাচনে আসি। আমরা গণমাধ্যমের সুবাদে আরও জেনেছি, সরকার উপজেলা পর্যায়ে দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে যাচ্ছে। গণমাধ্যমের প্রতিবেদন পাঠ করে আমার মধ্যে যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে সেটা হল- আবারও সেই দলীয় প্রতীকে নির্বাচন! দলীয় প্রতীকে নির্বাচনের অভিজ্ঞতা আমাদের সুখকর নয়। গত দুটি স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয়ভাবে অনুষ্ঠিত হয়েছে। গত বছর ডিসেম্বর মাসে পৌরসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় দলীয় ভিত্তিতে। এরপর এ বছরেই ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনও দলীয় ভিত্তিতে হয়। এ দুটি নির্বাচনে, বিশেষ করে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ব্যাপক মনোনয়ন বাণিজ্য হয়েছে। গ্রামেগঞ্জে এ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একটা নতুন ধরনের ব্যবসার সৃষ্টি হয়েছে। এটি টাকাবিহীন ব্যবসা। এর মাধ্যমে আমাদের স্থানীয় পর্যায়ের রাজনীতিকে আমরা ব্যাপকভাবে কলুষিত করে ফেলেছি। এটা প্রথমবার হয়েছে, আগে এমনটি হয়নি। আগে আমরা কেন্দ্রীয় পর্যায়ে মনোনয়ন বাণিজ্যের কথা শুনতাম। এগুলো অনেকটা গুজব আকারে ছিল। কেউ কারও বিরুদ্ধে কোনো সুস্পষ্ট অভিযোগ করেনি। কিন্তু এটা সবাই জানত যে, কেন্দ্রীয় পর্যায়ে মনোনয়ন বাণিজ্য হয়। এর মাধ্যমে আমাদের জাতীয় সংসদ ব্যবসায়ীদের করায়ত্ত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু স্থানীয় পর্যায়েও মনোনয়ন বাণিজ্য প্রসার লাভ করেছে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে।
    মনোনয়ন বাণিজ্যের কারণে স্থানীয় সরকারে অনেক বিতর্কিত ব্যক্তি মনোনীত হয়ে নির্বাচিত হয়েছেন এবং নির্বাচনটিও হয়েছে কলুষিত অর্থাৎ কারচুপিযুক্ত। দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচন হওয়ার কারণে বিরোধী দল, এমনকি সরকারি দলের সহযোগী দলগুলোও অভিযোগ তুলেছে যে, তাদেরকে মনোনয়নপত্র জমা দিতে বাধা দেয়া হয়েছে, বিভিন্নভাবে তাদের জন্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে এবং আমাদের আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী, প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন বিভিন্নভাবে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করেছে। যেটা আমাদের ইউনিয়ন পরিষদ এবং অন্যান্য স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। দলীয়ভিত্তিক নির্বাচনের ফলে আরেকটি বিষয় সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, সেটা হল- ব্যাপক সহিংসতা। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ১৪৫ জনের মতো ব্যক্তির প্রাণহানি ঘটেছে এবং অধিকাংশই ঘটেছে ক্ষমতাসীন দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে। অর্থাৎ নির্বাচনটি ছিল রক্তাক্ত। এতে অহেতুক অনেক প্রাণহানি ঘটেছে। যেটা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
    আমরা আশা করেছিলাম, আমাদের নীতিনির্ধারকরা জনকল্যাণে, মানুষের জানমাল রক্ষার স্বার্থে এবং আমাদের নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে কলুষমুক্ত রাখতে স্থানীয় সরকার নির্বাচন নির্দলীয়ভাবে করার পক্ষে সিদ্ধান্ত নেবেন। কিন্তু আমরা নিরাশ হয়েছি। তবুও আশা করব, সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বিষয়টি আবার ভেবে দেখবে।লেখকঃ ড বদিউল আলম মজুমদার,অর্থনীতিবিদ,গবেষক,আন্তর্জাতিক সংগঠক,স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ।