হেলপার থেকে যেভাবে অঢেল সম্পত্তির মালিকনূর হোসেন

    1
    240

    ৮০’র দশকের পর থেকে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর আশীর্বাদে বর্তমানে দেশেও বিদেশে অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন পেশায় সাবেক এই ট্রাকের হেলপার

    আমারসিলেট24ডটকম,০৪মেঃ নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ আলোচিত সাতহত্যাকাণ্ডের প্রধান সন্দেহভাজন আসামি নূর হোসেন।সাতজনকে অপহরণের তিন-চারদিন পরে একে একে তাদের মৃতদেহগুলো নারায়ণগঞ্জেরশীতলক্ষ্যা নদীতে ভেসে উঠতে থাকলে দেশব্যাপী এ নিয়ে ওঠে আলোচনা-সমালোচনারঝড়। এই ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত নূর হোসেন বর্তমানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগেরস্থানীয় নেতা হলেও এক সময় তিনি পেশায় ছিলেন ট্রাকচালকের সহযোগী। কিন্তু৮০’র দশকের পর থেকে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর আশীর্বাদে বর্তমানে দেশেও বিদেশে অঢেল সম্পত্তির মালিক হয়েছেন পেশায় সাবেক এই ট্রাকের হেলপার।

    স্থানীয় ব৮বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নূরহোসেন তার ব্যবসা ও সম্পত্তি ভারত ও মালয়েশিয়া পর্যন্তও সম্প্রসারণ করেছেন।এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন খোদ নূর হোসেনের অনুসারীরাও।

    অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের জন্য যা কিছু করা যায়, তার সব কিছুই করতে বাদ রাখেননিএই নূর হোসেন। ট্রাকচালকের সহযোগী থেকে আজ শিল্পপতিতে পরিণত হওয়া নূরহোসেন, ধনী হওয়ার সহজ উপায় হিসেবে অপরাধজগতকে ধন্যবাদ দিতেই পারেন তিনি!

    সড়ক ও যোগাযোগ খাতে, মাদক ব্যবসায়, দরপত্রের কাজ কৌশলে হাতিয়ে নেয়া, নদীদখল তো আছেই, এমনকি নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ ও ফতুল্লায় অবৈধ বালু ব্যবসাকরতেও ছাড়েননি তিনি। অপরাধজগতের প্রায় সবগুলো ক্ষেত্রেই অবাধে অনুপ্রবেশকরেছেন নূর হোসেন।

    এসব অবৈধ ব্যবসা নিয়েই নজরুল ইসলামের সঙ্গে কোন্দলে জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি।আর তাদের এই কোন্দল তখনই শত্রুতার সর্বোচ্চ সীমায় গিয়ে পৌঁছায় যখন প্যানেলমেয়র নির্বাচনে মাত্র একটি ভোটের ব্যবধানে নূর হোসেনকে হারিয়ে দিয়ে জয়লাভকরেন নজরুল।

    দেশীয় থিয়েটারের একটি ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান হলো যাত্রা। স্থানীয়রা জানান, গত বছর সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল ট্রাক টার্মিনালে নূর হোসেন এই যাত্রার নামকরে অশ্লীল অনুষ্ঠান মঞ্চস্থ করেছিলেন। এই ঘটনায় স্থানীয়দের প্রবল তোপেরমুখে পড়েন নূর হোসেন। তার বিরুদ্ধে নানা রকম বিক্ষোভ ও সমালোচনা হয়। কিন্তুতারপরেও পুলিশ এবং স্থানীয় প্রশাসনের নাকের ডগায় থেকেই যাত্রার নামে এইঅশ্লীল প্রদর্শনী অব্যাহতভাবে চালিয়ে গিয়েছিলেন তিনি।

    অসামাজিক এসব কার্যকলাপ বন্ধ করার নির্দেশ দিয়ে গত ১৬ এপ্রিল নূর হোসেনকেনোটিশ দিয়ে চিঠি পাঠান নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহীকর্মকর্তা। ওই চিঠিটির একাধিক অনুলিপি পাঠানো হয়েছিল নারায়ণগঞ্জ পুলিশসুপার এবং জেলা প্রশাসকের কাছে তো বটেই, এমনকি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও।

    গত বছরের এপ্রিল মাসে দায়ের করা একটি আবেদনের ভিত্তিতে ট্রাক টার্মিনালেসংঘটিত এসব অসামাজিক ও অবৈধ কীর্তিকলাপ অবিলম্বে বন্ধ করার জন্য সংশ্লিষ্টকর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন উচ্চ আদালত।

    কিন্তু স্থানীয়রা জানান, কোনোকিছুই নূর হোসেনকে এসব অপরাধ থেকে নিবৃত্তকরতে পারেনি। কারণ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা শামীম ওসমানেরআশীর্বাদপুষ্ট ছিলেন নূর হোসেন।

    ১৯৯২ সালে বিএনপিতে যোগদানের আগে নূর হোসেন ট্রাক চালাতেন এবং ট্রাকচালকেরসহযোগী হিসেবে কাজ করতেন। একই সময় সাবেক স্বৈরাচারী শাসক হুসেইন মুহম্মদএরশাদের জাতীয় পার্টির সঙ্গেও জড়িত ছিলেন তিনি।

    স্থানীয়দের অভিযোগ, সে সময় নারায়ণগঞ্জে যত যানবাহন চলাচল করতো সেগুলো থেকে পুলিশ প্রশাসনের হয়ে অবৈধ চাঁদাবাজি করতেন নূর হোসেন।

    এরপর বিএনপিতে যোগদানের পর বিভিন্ন পরিবহণ মালিকদের কাছ থেকে স্ব-উদ্যোগেইচাঁদার টাকা সংগ্রহ করতে তিনি। আর এভাবেই ধীরে ধীরে তিনি অন্যান্য অপরাধকর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন স্থানীয় বিএনপি নেতাদের সহায়তায়। পরবর্তীসময়ে তিনি সিদ্ধিরগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

    এরপর ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে নূর হোসেন রাজনৈতিক অবস্থান বদলেফেলেন এবং শামীম ওসমানের সহযোগিতায় ১৯৯৮ সালে তিনি আওয়ামী লীগে যোগদানকরেন। ফলে পরিবহণ মালিকদের কাছ থেকে জোরপূর্বক অর্থ আদায়, ভূমিদখল এবং অবৈধবালু ব্যবসার মতো কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকেই সরে আসতে হয়নি তাকে।

    ২০০১ সালে আবারো বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকার ক্ষমতায় এলে শামীম ওসমানএবং নূর হোসেন- দুজনেই দেশ থেকে পালিয়ে যান। ২০০৮ সাল পর্যন্ত তারা পলাতকছিলেন। বিএনপি সরকার এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকার- দুই শাসনামলেই অপরাধীহিসেবে পুলিশের তালিকাভুক্ত ছিলেন নূর হোসেন।

    ২০০৭ সালে নূর হোসেনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে খোদইন্টারপোলও। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটসরকার ক্ষমতায় এলে বেশ দর্পের সঙ্গেই দেশে ফিরে নূর হোসেন। শামীম ওসমানেরসহযোগিতায় আবারো অবৈধ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে থাকেন। এসব তথ্য নিশ্চিতকরেছেন স্থানীয়রা এবং আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সূত্র।

    সিদ্ধিরগঞ্জ এবং ফতুল্লা থানায় নূর হোসেনের বিরুদ্ধে ছয়টি হত্যা মামলাসহমোট ২২টি মামলা বিভিন্ন সময় দায়ের করা হয়েছে। সবগুলো মামলা থেকেই জামিনপেয়ে পালিয়ে যেতেন তিনি।

    গত ডিসেম্বরে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শামীম যেদিন আওয়ামী লীগের মনোনয়নলাভ করেন এর একদিন পরেই নারায়ণগঞ্জ শহর এবং শিমরাইলের সবগুলো ফুটপাত দখলকরেন নূর হোসেন। এরপর সেখানে তিনি অবৈধভাবে টিকেট কাউন্টার ও যাত্রী ছাউনিনির্মাণ করেন এবং শিমরাইল-নারায়ণগঞ্জ রুটে এবিএস পরিবহণ নামে বাস সার্ভিসচালু করেন।

    শীতলক্ষ্যা নদী থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন এবং নদীতীরে অবৈধ স্থাপনানির্মাণ করা থেকে নূর হোসেনকে বিরত রাখার জন্য ২২ বার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থহওয়ার পর সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় চিঠি পাঠায় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নদী যোগাযোগকর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)।

    ২০০৭ সাল থেকে সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতির পদে আসীন নূরহোসেন ২০১১ সালে অনুষ্ঠিত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ৪ নম্বরওয়ার্ড কাউন্সিলর হিসেবে নির্বাচিত হন।

    গত ২৭ এপ্রিল নজরুলসহ মোট সাতজনকে অপহরণের পরেই শেষবার নূর হোসেনকে দেখাগিয়েছিল সিদ্ধিরগঞ্জে। এর দুদিন পর গত ২৯ এপ্রিল থেকে পলাতক রয়েছেন তিনি।শনিবার নূর হোসেনের সিদ্ধিরগঞ্জের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে ১১জনকে গ্রেফতারকরেছে পুলিশ।খবর ডেইলি স্টার।