১৯৭১’র বীভৎস কালরাত আজঃ‘ব্ল্যাক-আউট’ কর্মসূচি

    0
    393

    “আজ ২৫ মার্চ রাত ৯টা থেকে ৯.০১ মিনিট পর্যন্ত (১ মিনিট)  কালরাত স্মরণে জরুরি স্থাপনা ছাড়া দেশের সব জায়গায় ‘ব্ল্যাক-আউট’ কর্মসূচি পালন করা হবে”

    আমারসিলেট টুয়েন্টিফোর ডটকম,২৪মার্চ,ডেস্ক নিউজঃ সেই আতঙ্কিত ভয়াল ও বীভৎস কালরাত আজ। ১৯৭১ সালের এই দিনে বাঙালি জাতির জীবনে নেমে আসে এক বিভীষিকাময় রাত। এদিন মধ্যরাতে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী পূর্বপরিকল্পিত ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের নীলনকশা অনুযায়ী আন্দোলনরত বাঙালির কণ্ঠ চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়ার ঘৃণ্য লক্ষ্যে সারা দেশে অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।

    ইতিহাসের সবচেয়ে বর্বরোচিত ও নিকৃষ্টতম গণহত্যা শুরু করে তারা। এটা ছিল মূলত বিশ্বসভ্যতার জন্য এক কলঙ্কজনক জঘন্যতম গণহত্যার সূচনা। সেই বিয়োগান্তক ঘটনা স্মরণে এবার দ্বিতীয়বারের মতো জাতীয় গণহত্যা দিবস হিসেবে পালিত হবে আজ। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির যৌথ উদ্যোগে আজ রোববার ‘গণহত্যা দিবস’ পালন করা হবে।

    ১৯৭১ সালের এই দিন সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ধানমন্ডির বাসভবনে সংবাদ সম্মেলনে দেশব্যাপী সামরিক বাহিনীর নির্যাতনের প্রতিবাদে ২৭ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে হরতাল পালনের ঘোষণা দেন। বঙ্গবন্ধু যখন এই ঘোষণা দিচ্ছিলেন, ঠিক তখন সন্ধ্যা সোয়া ৭টায় প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বিমানযোগে ঢাকা ত্যাগ করেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এ খবর পৌঁছে যায় বঙ্গবন্ধুর কাছে।

    রাত ৯টার পর বঙ্গবন্ধু তার বাসভবনে উপস্থিত নেতাকর্মী, সমর্থক, ছাত্র ও ছাত্রনেতা এবং সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, আমরা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছি। কিন্তু জেনারেল ইয়াহিয়া সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের মধ্য দিয়ে সমস্যার সমাধান করতে চাচ্ছেন। এ ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রেসিডেন্টই অখ- পাকিস্তানের সমাপ্তি টানতে চলেছেন।

    এদিন মধ্যরাতে পিলখানা, রাজারবাগ ও নীলক্ষেত আক্রমণ করে পাকিস্তানি সেনারা। হানাদার বাহিনী ট্যাঙ্ক ও মর্টারের মাধ্যমে নীলক্ষেতসহ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দখলে নেয়। সেনাবাহিনীর মেশিনগানের গুলিতে, ট্যাঙ্ক-মর্টারের গোলায় ও আগুনের লেলিহান শিখায় নগরীর রাত হয়ে ওঠে বিভীষিকাময়। পাকিস্তানি হায়েনাদের হাত থেকে রক্ষা পাননি রোকেয়া হলের ছাত্রীরাও।

    পাকিস্তানি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সঙ্গে আর্মি ইউনিট ৮৮-এর এক কথোপকথন থেকে জানা যায়, আনুমানিক ৩০০ ছাত্রীকে ওই রাতে হত্যা করা হয়। এ রাতেই ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব ও জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য, ড. মনিরুজ্জামানসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ৯ শিক্ষককে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে চলে নৃশংসতম হত্যার সবচেয়ে বড় ঘটনাটি। এখানে হত্যাযজ্ঞ চলে রাত থেকে সকাল পর্যন্ত। হত্যাযজ্ঞ চলে সার্জেন্ট জহুরুল হক হলেও। গোটা বিশ্ববিদ্যালয় অঞ্চল পরিণত হয় ভূতুড়ে এলাকায়।

    ঢাকার পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকলে বঙ্গবন্ধুকে শুভাকাক্সক্ষীরা তার বাসা ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নেওয়ার অনুরোধ করেন। বঙ্গবন্ধুর জন্য হেলিকপ্টারও প্রস্তুত রাখা হয়। তবে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে অস্বীকৃতি জানান। রাত সোয়া ১টার দিকে ট্যাঙ্ক, সাঁজোয়া গাড়ি ও এক লরি সৈন্য ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। তারা গুলি ছুড়তে ছুড়তে বাড়ির ভেতরে ঢোকে। তখন বাঙালির নেতা বঙ্গবন্ধু বীর বাঙালির মতোই নিজেই দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়ান।

    বাঙালির স্বাধীনতার স্বপ্নকে চিরতরে নিভিয়ে দেওয়ার অংশ হিসেবে পাকিস্তানি সেনারা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। অবশ্য গ্রেপ্তার হওয়ার আগেই বঙ্গবন্ধু তৎকালীন ইপিআরের ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতা ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা দিয়ে যান।

    বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ১১ মার্চ জাতীয় সংসদে ২৫ মার্চ জাতীয় গণহত্যা দিবস পালনের প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়। অক্সফোর্ড ডিকশনারি অনুযায়ী গণহত্যাকে সংজ্ঞায়িত করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এদিন সংসদে বলেন, ‘জাতিসংঘ ১৯৪৮ সালের ৯ ডিসেম্বর ‘জেনোসাইড কনভেনশন’ গ্রহণ করে। ২০১৫ সালের ৯ ডিসেম্বরকে ‘জেনোসাইড ডে’ হিসেবে ঘোষণা দেয়। কাজেই আমাদের কাছে সেই সুযোগ রয়েছে, জাতিসংঘের কনভেনশন অনুযায়ী আমরা ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে গ্রহণ করতে পারি।’

    সংসদ কার্যপ্রণালী বিধির ১৪৭ বিধিতে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) শিরীন আখতারের আনা প্রস্তাবের ওপর সাধারণ আলোচনা শেষে সংসদে তা সর্বসম্মতভাবে গ্রহণ করা হয়। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এ প্রস্তাবটি অনুমোদনের জন্য প্রস্তাব করলে সংসদ তা পাস করে। পরে ২০ মার্চ অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে ২৫ মার্চকে ‘গণহত্যা দিবস’ ঘোষণা এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে দিবসটি পালনের প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। দিবসটিকে ‘ক’ শ্রেণিভুক্ত দিবস অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাব মন্ত্রিসভায় অনুমোদন করা হয়।

    মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইন ২৫ মার্চ রাত সম্পর্কে লিখেছেন, ‘সে রাতে ৭০০০ মানুষকে হত্যা করা হয়, গেপ্তার হলো আরও ৩০০০ লোক। ঢাকায় ঘটনার শুরু মাত্র হয়েছিল। সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানজুড়ে সৈন্যরা বাড়িয়ে চলল মৃতের সংখ্যা। জ্বালাতে শুরু করল ঘরবাড়ি, দোকানপাট লুট আর ধ্বংস তাদের নেশায় পরিণত হলো যেন। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো কাক- শেয়ালের খাবারে পরিণত হলো। সারা বাংলাদেশ হয়ে উঠল শকুনতাড়িত শ্মশানভূমি।’

    রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ তার বাণীতে বলেছেন, ১৯৭১ সালের এই দিনে বাঙালির মুক্তি আন্দোলন স্তব্ধ করতে নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। ঢাকাসহ সারা দেশে চালানো হয় গণহত্যা। শহীদ হন ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, পুলিশ ও তৎকালীন ইপিআর সদস্যসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার অগণিত মানুষ। ২৫ মার্চের গণহত্যা শুধু বাংলাদেশেরই নয়, বিশ্বমানবতার ইতিহাসেও একটি কালো অধ্যায়।

    প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাণীতে বলেন, ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর আধুনিক মারণাস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঢাকাসহ দেশের প্রধান প্রধান শহর ও বন্দরে হত্যা করা হয় হাজার হাজার নিরীহ মানুষ। সেই রাত থেকে পরবর্তী নয় মাস পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনীর সদস্যরা সারা দেশে নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ চালায়।

    হত্যা করে প্রায় ৩০ লাখ মানুষকে। এত কম সময় ও স্বল্প পরিসরে এত বিপুলসংখ্যক মানুষ হত্যার নজির বিশ্বে আর নেই। শুধু মানুষ হত্যা নয়, একই সঙ্গে ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি করা হয়। লাখ লাখ বাড়িতে অগ্নিসংযোগ এবং লুটপাট করা হয়। বাড়িঘর থেকে বিতাড়িত করা হয় প্রায় এক কোটি মানুষকে।

    জাতীয় গণহত্যা দিবস উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্মৃতি চিরন্তন চত্বরে আয়োজন করা হয়েছে নানা অনুষ্ঠান। এগুলোর মধ্যে রয়েছে সন্ধ্যা ৭টায় স্মৃতি চিরন্তনে মোমবাতি প্রজ্বলন, ৭.০৫ টায় ডকুমেন্টারি প্রদর্শন এবং ৭.২০ টায় আলোচনা সভা। এছাড়া বাদ জোহর মসজিদুল জামিয়ায় ২৫ মার্চের রাতে নিহতদের স্মরণে বিশেষ মোনাজাত এবং বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার অন্যান্য ধর্মীয় উপাসনালয়ে অনুষ্ঠিত হবে প্রার্থনা সভা। রাত ৯টা থেকে ৯.০১ টা পর্যন্ত ২৫ মার্চ কালরাত স্মরণে জরুরি স্থাপনা ছাড়া সব জায়গায় ‘ব্ল্যাক-আউট’ কর্মসূচি পালন করা হবে।

    জগন্নাথ হলের কর্মসূচি : ২৫ মার্চ কালরাতে শহীদদের স্মরণে আজ রোববার জগন্নাথ হল পরিবার হল প্রাঙ্গণে এক স্মরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। তাছাড়া শহীদদের স্মরণে বিস্তারিত কর্মসূচি হাতে নিয়েছে হল কর্তৃপক্ষ। অনুষ্ঠানমালার মধ্যে রয়েছে- বিকাল ৪.০১ মিনিটে চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, সন্ধ্যা ৬.০১ মিনিটে স্থাপনা শিল্পের প্রদর্শন (ইনস্টলেশন আর্ট), সন্ধ্যা ৭.০১ মিনিটে দেশাত্মবোধক গান ও কবিতা আবৃত্তি, সন্ধ্যা ৭.৩০ মিনিটে নাটক (কালরাত্রি), রাত ৯.০১ মিনিট ব্ল্যাকআউট, রাত ৯.০১ মিনিটে গণসমাধিতে মোমবাতি প্রজ্বলন ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন, রাত ৯.০৫ মিনিটে মশাল প্রজ্বলন, রাত ৯.১০ মিনিটে আলোচনা সভা, রাত ১০.০১ মিনিটে শোকসংগীত এবং রাত ১১.১৫ মিনিটে প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনী।

    রোকেয়া হলের কর্মসূচি : কালরাতে রোকেয়া হলের অভ্যন্তরে যেসব নারী ও কর্মচারী পাকিস্তানি সামারিক বাহিনী কর্তৃক নির্যাতিত ও নিপীড়িত হয়েছিলেন, তাদের স্মরণে প্রথমবারের মতো রোকেয়া হল পরিবার এক স্মরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। আজ রাত ৮টায় এ অনুষ্ঠান হবে।

    আজ দেশ অন্ধকারে থাকবে এক মিনিট : কালরাতের প্রথম প্রহর স্মরণ করে গণহত্যা দিবসে আজ (২৫ মার্চ) এক মিনিট অন্ধকারে (ব্ল্যাক-আউট) থাকবে সারা দেশ। ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যার স্মরণে আজ রাত ৯টা থেকে ৯টা ১ মিনিট পর্যন্ত সারা দেশ অন্ধকার থাকবে।

    কালরাতে নিহতদের স্মরণে সারা দেশে এক মিনিট সব ধরনের বাতি বন্ধ রাখার কর্মসূচি নিয়েছে সরকার। ১১ মার্চ সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এদিকে গণহত্যা দিবসে এক মিনিট বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন রাখাসহ সরকারের বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগে চিঠি পাঠিয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়।

    চিঠিতে জানানো হয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, জননিরাপত্তা বিভাগ, বিদ্যুৎ বিভাগ, তথ্য মন্ত্রণালয়, গণযোগাযোগ অধিদপ্তর এবং সব জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) মাধ্যমে গণহত্যা দিবসে এক মিনিট ব্ল্যাক-আউট কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে।

    জাতীয় সংসদের স্বীকৃতির পর একাত্তরের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বর হত্যাযজ্ঞের দিনটিকে গত বছর ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। বাঙালির মুক্তির আন্দোলন নস্যাৎ করতে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে এ দেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে সে অভিযানে কালরাতের প্রথম প্রহরে ঢাকায় চালানো হয় গণহত্যা।