পুলিশি চাঁদাবাজি বনাম রমজান

    0
    247

    আমার সিলেট টুয়েন্টি ফোর ডটকম,০৬জুন,আশিকুল কায়েসঃ  আমাদের দেশের আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর মধ্যে পুলিশের বিশেষ অবদান অস্বীকার করার মতো নয়। কারণ তারা সর্বত্রই আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়োজিত থাকেন। ছোটবেলায় বাবা-কাকা ও দাদুর মুখে শুনেছি হাফপ্যান্ট পরিহিত কোন পুলিশবাবু গ্রামে ঢুকলেই নাকি রাস্তা ছেড়ে নেমে দাঁড়াতো সাধারণ লোকজন। কারোর বাড়ীতে ইনভেস্টিগেশনের নোটিশ দিলে আশ্রয়স্থল ছেড়ে পালানোর সুযোগ খুঁজতো ঐ বাড়ির সদস্যরা। কথাগুলো শুধু মাথায় আছে। আজকের বাস্তবতায় পুলিশের চেয়ে চৌকিদার খ্যাত গ্রামপুলিশকেই বেশি ভয় করে চলতে হয়। ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যানের চেয়ে চৌকিদারের আধিপত্যই বেশি। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াও তাদের রয়েছে সাধারণ মানুষকে হ্যারেস করার মতো লম্বা-চওড়া ক্ষমতা।

    আসুন সংক্ষেপে বোঝার চেষ্টাকরি বাংলাদেশ পুলিশের মূলত কাজটা কি? ‘বাংলাদেশের প্রধান অসামরিক আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাম বাংলাদেশ পুলিশ। সংস্থাটি বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কর্তৃক পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। চুরি-ডাকাতি রোধ, ছিনতাই প্রতিরোধ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ইত্যাদি সমাজ বিরোধী কর্মকান্ড প্রতিরোধসহ বিভিন্ন জনসভা, নির্বাচনী দায়িত্বে বাংলাদেশ পুলিশের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়ে থাকে।’ সচরাচর আমরা তাদের দায়িত্বমূলক কর্মকান্ডেও যথাযথ প্রমাণ পাই।

    পুলিশ সম্পর্কে জ্ঞান আমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেই পেয়েছি। তাদের কর্মকান্ড সম্পর্কে কমবেশি স্বাভাবিকভাবেই আমরা সবাই জানি। তাদের সকল নৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রতি দেশের জনগণের আস্থা থাকলেও তথাকথিত অধিকাংশ পুলিশের উপর নয়। সকল নৈতিক কর্মকান্ডে পুলিশের সম্পৃক্ততা সর্বপরি নিশ্চিত থাকলেও বর্তমান সমাজের মানুষের কাছে পুলিশ একটি জুজুতে পরিণত হয়েছে এটা স্বীকার করতে বাধ্য। বিগতদিনে মানুষ ভয় করতো অনৈতিকতার খোঁজে পুলিশের অভিযানের সম্পৃক্ততাকে আর এখন ভয় পায় তাদের কর্মকান্ডের নৈতিকতাকে প্রদর্শন করে অনৈতিক ব্যবহারকে। নৈতিকতাকে কালোকাপড়ে ঘষে নৈতিক কর্মকান্ডকে চকচকে করার নামমাত্র দায়িত্ব পালন করে। সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের মধ্যে পুলিশ সম্পর্কে যে জ্ঞানটুকু রয়েছে সেটা বর্তমান পুলিশের খাকি ড্রেস সম্পর্কেও স্পষ্ট করে না। “মিথ্যাতো দিব্যি পায়ের উপর পা তুলে তথাকথিত সমাজে রাজত্ব করে চলেছে। মিথ্যা কি সেটাই! – যেটার পরিপূর্ণ প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞান আমাদের মধ্যে ভর করে ? নাকি বাস্তবতার প্রেক্ষিতে যা দেখতে দেখতে আমরা পুরটায় অভ্যস্থ।” কোনটা বিশ্বাস করবো? রাস্তার মোড়ে মোড়ে পুলিশের ধান্দাবাজি! ব্যবসায়ীর পকেট কেটে নিজের পকেটে টাকা পাচার করার জন্য ওতপেতে বসে থাকা ট্রাফিক পুলিশকে ? নাকি অনৈতিকভাবে একজন সাধারণ মানুষকে ধরে নিয়ে হাজতে পুরে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করা কর্মকর্তাকে ? কয়েকদিন হলো ঢাকার নবাবপুর রোডের মাথায় কর্তব্যরত ট্রাফিক পুলিশকে নজরে রাখছিলাম। অফিসে আসার সময় প্রায় আধঘন্টা সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকি, তার আয় করা রোজগারের অঙ্কটা দেখার জন্য। রিকসা কিংবা ভ্যান গাড়িতে কোন মালামাল পরিবহন হতে দেখলেই হাতে থাকা যাদুর লাঠি দিয়ে একটি আঘাত করলেই মুঠে চলে আসে কয়েকটা দশটার নোট। ২ টাকা কিংবা ৫টাকায় ট্রাফিক পুলিশের কাছ থেকে এখন আর ছাড় হয় না, সর্বনিম্ন ১০ টাকা লাগে। এমনটাই মন্তব্য করেছিলেন একজন রিকসাওয়ালা। আমি আমার পরিচয় জানিয়ে ট্রাফিক পুলিশের সাথে কথা বলতে চাইলাম ১ কাপ চা খাওয়ার নিমন্ত্রণ করে। তিনি আমাকে এইমুহূর্তে কোন সুযোগ দিতে চান না। আগামী যেকোন একটি তারিখ নির্ধারণ করে বললেন দুপুরের খাবারের পর বসবেন। যথারীতি আমি সেদিন সেখানে গিয়েছিলাম। দেখেছিলাম ঐ পুলিশের পরিবর্তে অন্য কেউ দায়িত্ব পালন করছেন।

    নিজের চোখে দেখা যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তার মোড়ে রীতিমত একজন চৌকস ব্যক্তিকে পুলিশের এজেন্ট করে রেখেছে। টাকা সংগ্রহটা তার হাত ধরেই আসে। শুধু কর্তব্যরত পুলিশ তার যাদুর লাঠি দিয়ে মালবাহী গাড়ীতে একবার আঘাত করে সংকেত জানিয়ে দেয়।

    মেস পাল্টানোর জন্য ভ্যানগাড়ি ঠিক করলেও বস্তাবন্ধি বইয়ের জন্য পুলিশের কাছে দিতে হয় কঠিন জবাব, বস্তাখোলা, চেক করা ইত্যাদি নানাবিধ ব্যস্ততার মধ্যে রেখে হেস্তন্যেস্ত করার চেষ্টা চলে। নিজের চোখে দেখেছি তল্লাশি করার নাম নিয়ে পন্য এমনভাবে অগোছালো করে তা আসলে পন্যমালিকের জন্য খুবই দু:খজনক। আসলে এর পেছনে থাকে টাকা খাওয়ার ধান্দা। তবে সেক্ষেত্রে ছাত্রদের একটু ছাড় আছে।

    মার্কেট, ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি, বিভিন্ন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান কোন কিছুই পুলিশের নজরদারির থেকে অবমুক্ত নয়। দিন কিংবা মাসিক হারে তাদের চাঁদাবাজির মহড়া চলেই। গুলিস্তান, সদরঘাট, পল্টন, মালিবাগ গোপিবাগ এমনকি ঢাকা শহরের কোন এলাকা পুলিশি চাঁদাবাজি থেকে মুক্ত নয়। সারাবছরই চলে এধরনের পুলিশি পায়তারা। পুলিশের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়োমের অভিযোগ সকলের জানা অথচ ব্যসায়ের স্বার্থে তাদের মুখ থেকে বুলি আওড়াইনা। প্রশাসন থেকে শুরু করে মন্ত্রী বিভাগ পর্য্যন্ত পুলিশের এহেন কর্মকান্ড সম্পর্কে অবগত। তাদের এই বিশৃঙ্খলাকে শৃঙ্খলায় পরিণত করতে উর্ধতন কর্তৃপক্ষে মাথাটা একটু কমই নড়ে। কেন ? সেটার উত্তর খুঁজে পাওয়া আদৌও সম্ভব নয়। তবে এই দেশে যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক না কেন তাদের মাথাটা একটু ঝোকালেই তাদের এই অনৈতিক ধান্দাবাজি হালালে পরিণত হবে। দুর্নীতি-অনিয়োমের বীজ পুলিশ প্রশাসনের মধ্যে বপন হওয়ায় সেই আবহাওয়াটা জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে দুর্নীতি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। শুধু পুলিশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না, অফিস-আদালত এমনকি সর্বস্তরে জনগণের মধ্যে ইনজেকশনের মত পুষ হয়ে যাচ্ছে এই দুর্নীতি। বকশিস প্রথা থেকে শুরু করে কমিশন খাওয়া, বিশেষ করে দুর্নীতির শুরুর পথকে আরও স্পষ্ট করে দিয়েছে। এরই সূত্র ধরে জনগণের সাথে বন্ধুত্বের সুযোগ নিয়ে কিছু দুর্নীতিবাজ পুলিশ তাদের ফায়দা লুটে চলে। পুলিশের বন্ধু জনগণও সুযোগ পেয়ে যায় পুলিশি সমর্থন পেয়ে। আর দুর্নীতিও চলে লাগামহীন।

    রমজান মাসে পুলিশের চাঁদাবাজি থেকে জনগণ কতটা অবমুক্ত সেটাই এখন দেখার বিষয়। ধর্মমতে রমজান মাস হলো সিয়াম-সাধনার মাস। স্বাভাবিকভাবেই রমজান মাসে পুলিশের এই দৌরাত্য একটু কমই হবে। কেননা মুসলিম পরিবারের একজন পুলিশ ঘুষ কিংবা চাঁদাবাজির পথ থেকে সরে নিজেকে শুদ্ধ করার চেষ্টা করবে। একথাটা সম্পূর্ণরূপে ভুল। সদরঘাটের এক পুলিশকে দেখেছি রমজান মাসের সময় অনৈতিকভাবে জনগণের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করার পর আযান পরবর্তী সময়ে নামাজ পড়ার জন্য প্রস্তুতি নিলে একটুও বিভ্রান্তিতে থাকেননা। কেননা মসজিদে প্রবেশের পূর্বে পাশেই মুদিখানার দোকানে পুলিশি লাঠি রেখে প্রবেশ করেন। তারমানে এটাই দাঁড়ায় যত অপকর্মের মূল ঐ লাঠিটি। অন্যান্য মাসের থেকে রমজান মাসে পুলিশের আয় রোজগারের পরিমান অনেক বেশি। এই সুযোগটা তারা কোনভাবেই হাতছাড়া করতে চান না বিধায় তাদের সারাবছরের সাধনা থাকে রমজান মাস পাওয়ার। আবার ঐ একই এলাকার কথা বলি- দুঃখি মানুষের জন্য আমরা আমাদের প্রাণের সংগঠন বাংলাদেশ তরুণ লেখক পরিষদের এক প্রতিনিধি দল যখন কাপড় বিতরণ করছিলাম, তখন রাত ১২-১টার মধ্যে হবে, সদরঘাটের রাস্তায় আমাদের একটি পুলিশের সাথে সাক্ষাত। আমাদেরকে নিয়ে গেল একটি ভবনের নীচে এক বৃদ্ধামহিলাকে কাপড় দেওয়ার জন্য। অন্যের প্রতি পুলিশের এই মহানুভবতা আমাদেরকে আকৃষ্ট করেছিল। পরিচয় হয়েছিল একজন ভালো ও দায়িত্ববান পুলিশের সঙ্গে। এভাবে মেলে শতকরা ৫-১০ জন ভালো পুলিশের সন্ধান।

    আমাদের কারোর মোবাইল ছিনতাই করে ছিনতাইকারি দৌড়ে পালানোর সময় তাকে হাতে নাতে ধরে পুলিশে সোপার্দ্য করা হয়। পুলিশ আমাদের মোবাইল সহ ছিনতাইকারিকে নিয়ে গেল থানায়, সাথে আমরাও। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে মোবাইলটা রেখে দিয়ে বলে কোর্ট থেকে ছাড়িয়ে আনতে। আমাদেরকে রীতিমত আইন দেখিয়ে দিল। অবশেষে নিরুপায় হয়ে ছিনতাইকারীর বিরুদ্ধে কোন স্টেটমেন্ট না করেই মোবাইলটা নিয়ে চলে আসতে হলো। আর নির্বীচারে ছাড়া পেয়ে গেল ঐ ছিনতাইকারী। যেদেশে প্রশাসনের মধ্যে ভাইরাস নামক দুর্নীতির অমোঘ অভিযোগ রয়েছে সেই দেশে প্রশাসনের মাধ্যমে সরকার কি আশা করতে পারে ? শতকরা পাঁচ-দশজন পুলিশ দিয়ে হয়তো আজ প্রশাসন ঠিক রাখতে পারলেও একসময় চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে মুখ থুবড়ে পড়বে দেশের মাটিতে। দেশের এই ক্রান্তিকালে আমাদের দেশকে ভূলুণ্ঠিত করার সুযোগ নেবে প্রতিবেশী দেশগুলো।

    দৈনিক যুগান্তর ও দৈনিক জনকণ্ঠে দেখলাম ‘সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া পুলিশ কোন যানবহন তল্লাশি করবে না’ আবার অনেক অনলাইন পত্রিকায়  ‘ আইজিপি বলেছেন-রমজান ও ঈদের মধ্যে পুলিশ কোন চাঁদাবাজি করবে না।’ এটা যদি হয় আইজিপির মন্তব্য তাহলে পুলিশ সম্পর্কে আমাদের দেশের অবস্থানটা কোথায় গিয়ে ঠেকেছে। প্রশাসন যদি নিজের থেকে স্বীকারোক্তি দেয় তাহলে সাধারণ জনগণের মধ্যে জুজুর অবস্থান নেওয়াটা কি স্বাভাবিক নয়?

    এটা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই পুলিশবাহিনীর মধ্যে অনেক পুলিশ আছেন যারা তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য অবহেলা করেন না। যথাযথভাবে তাদের দ্বায়িত্ব পালন করে থাকেন। আর তাদের জোরেই এখনও পুলিশ প্রশাসনের চেইন অব কমান্ড ঠিক আছে। তবে লক্ষ পুলিশের ভীড়ে এমন দায়িত্ববান পুলিশের সংখ্যা খুবই কম। তাই প্রশাসনের উচিত তাদের উপর অর্পিত দায়িত্বের বিষয়ে অধিক সচেতন থাকা। লেখকঃআশিকুল কায়েস-সভাপতি,বাংলাদেশ তরুণ লেখক পরিষদ।