মে দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য:মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান

0
37
মে দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য:মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান

আমার সিলেট রিপোর্ট: যেমনটি ঘটে ছিল ১৯৫২ ও ১৯৭১ সালে বাংলায় তেমনটি ঘটে ছিল ১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো নগরীতে। ১৯৫২ সালে বাংলার ছেলেরা মায়ের ভাষা বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা করার জন্য জীবন দিয়েছিল। এ কারণে ২১ ফেব্রুয়ারীকে প্রথমে শহীদ দিবস ও পরে জাতিসংঘের সম্মতিতে ১৮৮টি দেশে পালিত হয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। ১৯৭১ সালে বাংলা মাকে রক্ষা করার জন্য জীবন দিয়েছিল বাংলার ৩০ লক্ষ বীর সৈনিক এবং ইজ্জত দিয়েছিল ২ লক্ষ মা-বোন। তাইতো ঘটনাটি যেমন পৃথিবীর বুকে অমর হয়ে থাকবে তেমন পৃথিবীর বুকে স্থান পেয়েছে বাংলাদেশের মানচিত্রটি। আর ১৮৮৬ সালের মে মাসের প্রথম দিবসেও ঠিক ঘটেছিল এমন কিছু ঘটনা আমেরিকাতে, যাকে কেন্দ্র করে ১মে সমস্ত বিশ্বে চিহ্নিত হয়েছে মহান মে দিবস হিসাবে। তাছাড়া ১লা মে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে দিনটি শুধু চিহ্নিত নয় রক্ত অক্ষরে লেখা সমগ্র বিশ্বে শ্রমজীবী মানুষের এক স্মরনীয় ঘটনা।
শ্রমিকদের লড়াই, সংহতি, দৃঢ়তা ও রক্তের বিনিময়ে ছিনিয়ে আনা অর্জিত বিজয় দিবসই মে দিবস। শ্রমিকরা ঘটনাটি ঘটিয়েছিল বলে মে দিবসকে আবার শ্রমিক দিবস বলা হয়। আন্দোলন ও সংগ্রামের মূলে ছিল শোষণ ও নিপীড়নের অবসান ঘটিয়ে গনতান্ত্রিক অধিকার আদায় ও সংরক্ষণ করা। ১৮৮৬ সালে ১মে তারিখে আমেরিকার শিকাগো শহরে শ্রমিকরা ৮ ঘন্টা কাজের দাবি আদায়ের লক্ষে গড়ে তুলে ছিল সংগ্রাম ও আন্দোলন এবং শেষ পর্যন্ত জয় করে এনেছিল জয়ের মালা। তবে শুধু আমেরিকার শ্রমিক সমাজেই নয় অন্যান্য দেশের শ্রমিক সমাজেও সমর্থন লাভ করে ছিল। বস্তুতঃ এরই ফলে শ্রমিক সমাজ তথা মেহনতি মানুষের দাবি অনুযায়ী দিনের ৮ ঘন্টা কাজের সময় নির্দিষ্ট হলো এবং সুযোগ সুবিধা লাভের পথও হলো প্রশস্ততর।
শ্রমিকদের শোষণ ও নিপীড়নের ইতিহাস বহুকালের। যুগে যুগে দেশে দেশে খেটে খাওয়া শ্রমিক মানুষদের উপর চলেছে শোষণ, অত্যাচার ও নিপিড়ন। অবশ্য ১৮৮৬ সালের অনেক আগে থেকে শ্রমিকদের উপর জুলুম বন্ধ করা, তাদের কাজের সময় কমানো ও ছুটির ব্যবস্থা করার বিরুদ্ধে সূচিত হয় আন্দোলন। এর জন্য আশ্রয় নেওয়া হয়েছিল আন্দোলন, ধর্মঘট, পুলিশের প্রতিরোধ, জুলুমের মুখে আত্মত্যাগ ইত্যাদি। কিন্তু কোন কিছুতে অধিকার আদায় হয়নি। যে কারণে অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৮৮৬ সালের ঐতিহাসিক আন্দোলন ও পরে সাফল্য অর্জনের জন্য। এই ঐতিহাসিক আন্দোলনের ইতিহাস পড়লে আরও গভীর ভাবে উপলব্ধি করা যাবে মে দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য।
মে দিবসের ইতিহাস এক রক্তাক্ত ইতিহাস। সভ্যতার পদচারণা হয়েছে যাদের শ্রমে সেই শ্রমিকদের অলিখিত নিয়ম সূর্যোদয় থেকে সুর্যাস্ত পর্যন্ত খাটিয়ে নেওয়া হত। কিন্তু লোভী মুনাফাখোর মালিকেরা শ্রমিকদের প্রতিদিন ১৪ থেকে ১৮ ঘন্টা খাটিয়ে নিত। উনিশ শতক জুড়েই তাই বিশ্বময় শ্রমিক আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে কাজের সময় কমানোর দাবিতে এবং ঊনিশ শতকের শেষ ভাগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এ আন্দোলোন তীব্র ভাবে দানা বেঁধে ওঠে। যুক্তরাষ্ট্রের সরকার তখন সরকারি অফিস সমূহের শ্রমিকদের সময়সীমা ১০ ঘন্টায় আনলেও ব্যক্তি মালিকেরা সেটা মেনে নেয়নি। পক্ষান্তরে শ্রমিকরাও দাবি তোলে কাজের সময়সীমা নামিয়ে ৮ ঘন্টায় আনার জন্য। সেই সুবাদে আন্দোলনের সময় ধার্য করা হয় ১৮৮৬ সালের মে মাস। মে মাসের প্রথম দিন থেকেই শুরু হয় ধর্মঘট, মিছিল ও সমাবেশ। মাসের ৩ তারিখে মালিক পক্ষের ভাড়াটিয়া বাহিনী ও পুলিশ শ্রমিকদের উপর চালায় জেল, জুলুম ও গুলিবর্ষণ এবং এতে নিহত হয় আমেরিকার শিকাগো শহরের অগাস্ট স্পাইস, পারসন্স, এঞ্জেল ও ফিশার সহ ৬ জন শ্রমিক ও আহত হয় অনেকে। সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাটি প্রতিবাদের ঝড় তোলে এবং শেষ পর্যন্ত ঐতিহাসিক ও অবিস্মরনীয় শ্রমিক আন্দোলনকে দমাতে পারিনি। তার ফলে তারা সাফল্যের ঐতিহাসিক নজির স্থাপন করতে সমর্থ হয়েছে। ১৮৮৬ সালের ১লা মে তারিখে গড়ে ওঠা শ্রমিকদের এই ৮ঘন্টা সময়সীমার জন্য আন্দোলন নানান দমননীতির মধ্যদিয়ে জয় লাভ করে এবং সোসালিষ্ট আন্তর্জাতিকের ২য় কংগ্রেসে ১৮৮৯ সালে গৃহীত এক প্রস্তাবে স্থির হয় যে- হে মার্কেটে নিহত শ্রমিকদের স্মরণে ১৮৯০ সাল থেকে ১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসাবে পালিত হবে এবং সেটা সকল দেশের সরকারি আই, এল, ও, (ও.খ.ঙ) কনভেনশনে স্বাক্ষর দিয়েছে ও সেটা মেনে চলতে অঙ্গীকারবদ্ধ। স্বাধীন বাংলাদেশের শ্রমিকরাও দিবসটি পালন করে। শুধু তাই নয় বাংলাদেশ সরকার মে দিবসকে সরকারী ছুটির দিন হিসাবে ঘোষণা করেছে।
শ্রমিক সমাজ ও মেহনতি মানুষ উৎপাদন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের বড় শক্তি হিসাবে দেশে দেশে গন্য হওয়ায় ও স্বীকৃতি পাওয়ার ফলে তাদের অধিকার ও সুযোগ সুবিধাও স্বীকৃতি হয়েছে ১৮৮৬ সালে। শিকাগোর ঐতিহাসিক ঘটনা এবং পরে মহান মে দিবস উদ্যাপনের দীর্ঘ ঐতিহ্য শুধু শ্রমিক সমাজ ও মেহনতি মানুষের অধিকার সচেতনে ঐক্যবদ্ধ ও দাবি আদায়ে সক্ষমই হয়নি, এর ফলে শোষণ ও বঞ্চনার অবসান ঘটিয়েছে অনেকখানি। শ্রমিক ও মেহনতি মানুষ যে উৎপাদনের বড় শক্তি ও হাতিয়ার, অর্থনৈতিক উন্নয়ন বিকাশ ও সমৃদ্ধিতে যে এ শক্তির উপর বিশেষ ভাবে নির্ভলশীল। এছাড়া সংগ্রামী ও মেহনতি মানুষ যে শক্তি হিসাবে বিরাট এ উপলব্ধি সৃষ্টিতে এবং স্বীকৃতি অজর্নেও ঐতিহাসিক মে দিবসের অবদান অনেকখানি। সত্যি কথা বলতে কি শ্রমিক সমাজ ও মেহনতি মানুষের গনতান্ত্রিক অধিকার ও স্বার্থ সংরক্ষণে ও তাদের কল্যাণে দেশে দেশে যে সকল ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে ও অগ্রগতি সাধিত হয়েছে তার পিছনেও মে দিবসের ঐতিহাসিক ঘটনা ও তার সাফল্যের অনুপ্রেরণা ও অবদান কম নয়।
গণতান্ত্রিক অধিকার ও স্বার্থ আদায় ও সেটা সংরক্ষণের জন্য ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা যেমন প্রয়োজন, তেমন এসকল অধিকার দয়া ও স্বার্থ সংরক্ষণের ক্ষমতা ও দায়িত্ব যাদের তাদেরও উদারও অনুকুল দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সহযোগিতার হাত বড়িয়ে দিতে হবে। মহান মে দিবস প্রতিটি শ্রমজীবী মানুষকে নিজেদের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি জোরদার করতে শিক্ষা দেয়। মে দিবসের মহান আদর্শের কথা স্মরণ রেখে ন্যায্য দাবি প্রতিষ্ঠা, আদায় ও কল্যাণমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে শ্রমিক সমাজ ও মেহনতি মানুষ এবং কর্তৃপক্ষ উভয় পক্ষ থেকে সহযোগিতামূলক মনোভাব গ্রহণ করলেই আর কোন সমস্যার উদ্ভাবন না হয়ে উৎপাদন অব্যহত থাকবে এবং জাতীর পক্ষে এটাই কল্যাণকর হবে।
লেখক-গবেষক, কলামিস্ট মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান।