নৈতিকতার অবক্ষয়:জাতীয় জীবনে অধঃপতন

0
305

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান: মানবকল্যাণের সব বিষয়ের প্রধান নির্ণায়ক হলো নৈতিকতা। নৈতিকতার অভাবে শিক্ষক সঠিকভাবে শিক্ষাদান করেন না। ছোট পদে কর্মরতদের কাছ থেকে পাই পাই করে কাজ বুঝে নিলেও অফিসের বসরা ঠিকমতো কাজ করেন না। অন্যের প্রাপ্য ঠিকমতো বুঝিয়ে দেন না, কিন্তু নিজেরটা কড়াইগণ্ডায় বুঝে নেন। অন্য মানুষকে পদে পদে হয়রানি করা হয়, ঠকানো হয়। এভাবে মানুষের সেবা বা মানবসেবা হয় না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত ধর্মশিক্ষার সুযোগ নেই; নৈতিকতা শেখার সুযোগ নেই বললেই চলে। নেপধ্যে থেকে শিক্ষা কারিকুলাম যিনি ঠিক করেন, হয়তো তিনি ঘুস খেতে খেতে এ পদে এসেছেন, তাহলে তার হাত দিয়ে ঘুষকে নিরুৎসাহিত করার পাঠ্য আশা কীভাবে করা যায়? বাবা-মা বা পরিবারের অন্য সদস্যদের অসদাচরণ, মিথ্যাচার, দুর্নীতিপরায়ণতা, ভারসাম্যহীন ব্যবহার শিশু-কিশোরকে বিপথগামী করে তোলে। এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। কাজেই পরিবার থেকেই শিশু-কিশোরদের নৈতিক শিক্ষা প্রদান শুরু করতে হবে। পরিবারের সদস্যদের সর্বত্রই নৈতিক আচরণ করতে হবে। তা করা না গেলে সমস্যায় পড়তে হবে। প্রকৃতপক্ষে নৈতিকতা শেখার সুযোগ কম। পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সমাজে নৈতিকতা শেখার সুযোগ খুবই কম। অথচ নৈতিকতার মধ্যেই লুকিয়ে আছে সততা, মহত্ত্ব, ন্যায়পরায়ণতা, আদর্শবাদিতা, লোভ-লালসা, উচ্চাভিলাষ ও বিবেচনাহীন যৌন কামনা মানুষকে অসৎপথে পরিচালিত করে। ফলে সমাজ ও দেশ ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যায়। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে পারিবারিক শিক্ষা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্ম ও নৈতিকতা শিক্ষা দেওয়ার বিকল্প নেই।
সমাজে অস্থিরতা, অপরাধপ্রবণতা, লাগামহীন দুর্ঘটনা বাড়ছে। হতাহতের সংখ্যাও বাড়ছে। খবরের কাগজের পাতা ওল্টালেই নজরে পড়ছে ধর্ষণ, পাশবিক নির্যাতনের নানা ঘটনার খবর। পৈশাচিক কায়দায় খুন, শিশু নির্যাতন, সন্ত্রাসবাদ, মাদক, লুটপাট, দুর্নীতি, মারামারি আর হানাহানির খবর তো নিত্যদিনের পত্রিকার পাতা ভরে থাকছে। আমাদের দেশে পারিবারিক কলহ, হিংসা-বিদ্বেষ এসবও অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে। বিগত সময়গুলোয় পারিবারিক কলহের কারণে পরিবারের সবার একসাথে আত্মহত্যার মতো ঘটনাও ঘটছে। স্বামী-স্ত্রীর কলহে প্রাণ দিতে হচ্ছে নিষ্পাপ শিশুদের। ধর্ষণ করে শিশু ও নারীদের নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে, যা বর্বর যুগকেও হার মানিয়েছে। দেশে কিশোর গ্যাং এখন বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। নীতি-নৈতিকতার দুর্ভিক্ষ চরম আকার ধারণ করেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ পুলিশের অপরাধ বিভাগের তথ্যানুযায়ী, বছরে মোট হত্যাকাণ্ডের প্রায় ৪০ শতাংশ সংঘটিত হচ্ছে পারিবারিক কলহের কারণে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অবক্ষয় একদিনে সৃষ্টি হয়নি। সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে এসব অপরাধ বহু বছর ধরে ছড়িয়ে পড়েছে। এটা রোধ করতে হলে পরিবার-সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে মূল ধারায় ফিরে আসতে হবে।
দেশ কোনদিকে এগোচ্ছে?
আমরা দেশের বড় বড় শহরের দিকে তাকালেই দেখতে পাই সুবিশাল অট্টালিকা। মনে হয় যেন দেশ এগোচ্ছে হু-হু করে; তবে সামাজিক মূল্যবোধ যে অবক্ষয়ের দিকে দ্রুত ধাবিত হচ্ছে, তা যদিও চোখে দেখা যায় না, অনুভব করা যায়। আর তার ফলে যা হয় আমরা তা প্রত্যক্ষও করছি ব্যক্তি এবং সমাজ জীবনে; কিন্তু বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছি কম। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি, এটি নৈতিকতার অবক্ষয়েরই প্রমাণ। দেশের বৈষয়িক উন্নতির সঙ্গে নৈতিকতার অধঃপতন নিয়ে সমাজবিজ্ঞানীরা চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। কয়েক যুগ আগে যেসব অপরাধের কথা চিন্তা করা যেত না, এখন সে ধরনের অপরাধ সমাজে সংঘটিত হচ্ছে দেদার। পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হচ্ছে শিশুরা! এখন যারা শিশু এবং আস্তে আস্তে বেড়ে উঠছে তাদের ক্রীড়া ও সাংস্কৃতি চর্চার সুযোগ কম। বিশেষ করে শহুরে বাচ্চারা খেলাধুলার সুযোগ পায় না। শহরের বাচ্চাদের খেলার মাঠ নেই, আত্মীয়-স্বজনদের বাসায় আসা-যাওয়া প্রায় বন্ধ। তারা ফ্ল্যাটবন্দি হয়ে ‘আরবান’ সংস্কৃতিতে বড় হচ্ছে। এক ধরনের বিচ্ছিন্নতার মধ্যে বড় হচ্ছে আজকের শিশুরা। তাদের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার জন্য খেলার মাঠ, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। প্রযুক্তির যেমন ভালো দিক থাকে, আবার খারাপ দিকও থাকে। ইন্টারনেট সহজলভ্য হওয়ায় বাচ্চারা সেটা ব্যবহার করছে। তাদের আর নিয়ন্ত্রণও করা যাচ্ছে না। ফলে তারা ইন্টারনেটে খারাপ জিনিসই বেশি দেখছে। শুধু তাই নয়, ক্রমেই শিশুরা পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত হয়ে পড়ছে। নিয়মিত পর্নো ছবি দেখলে পড়ালেখা তো দূরে থাক, অন্য কাজেও মনোযোগ দিতে পারে না তারা। এতে করে তাদের সুস্থ-স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত হয়। তারা হয়ে ওঠে বিকৃত মননের। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ডা. জিল্লুর রহমান খান রতন মনে করেন, শিশু বয়সে পর্নোগ্রাফি দেখলে পরবর্তীতে তার স্বাভাবিক যৌন সম্পর্ক নিয়ে ধারণা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অশ্রদ্ধাবোধ তৈরি হয় বিপরীত লিঙ্গের মানুষের প্রতি। এমনকি সামাজিকভাবে অপরাধেও জড়িয়ে পড়তে পারে শিশুরা। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে আরও বলেছেন, আজকাল যারা স্কুলে পড়ে, তারাও মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ছোট ছোট ভিডিও আদান-প্রদান করে। তাছাড়া শিশুরা যে শুধুমাত্র শিশুদের নিয়ে তৈরি পর্নোগ্রাফি দেখছে, বিষয়টা তো তা নয়। তারা ‘অ্যাডাল্ট’ বা প্রাপ্তবয়স্কদের নিয়ে তৈরি পর্নোগ্রাফিও দেখছে।
শিশুদের পর্নোগ্রাফির প্রতি বেশি আসক্তির প্রধান কারণ হলো, তারা এখন চাইলেই যে কোনো ওয়েবসাইটে ঢুকে যেতে পারে। এরপরই তারা নানা খারাপ কিছু দেখছে। একসময় ঢাকায় ও মফস্বল শহরেও গোপনে বিক্রি হতো ‘চটি বই’। রসাত্মক গল্পের সেই বইগুলো লেখা হতো ছদ্মনামে। চটি বইয়ের বাইরে ‘জলসা’, ‘নাট্যরাজ-’এর মতো নিরীহ নামের কিছু ‘পিনআপ’ ম্যাগাজিনও ছিল, যেগুলো প্রকাশের উদ্দেশ্যই ছিল নারীদেহ এবং যৌনকর্মের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়ে পাঠকমনে যৌন উদ্দীপনা জাগানো। এছাড়া বড় শহরগুলোয় ‘প্লেবয়’ ম্যাগাজিনও পাওয়া যেত। আর এখন আগের সব বাজে ম্যাগাজিন আগের মতোই আছে, সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অবাধে ইন্টারনেট ব্যবহার করে যে যার মতো করে খারাপ কিছু দেখার সুযোগ। অভিভাবকরা বলছেন, বাচ্চাদের খেলার মাঠ নেই, সাংস্কৃতিক কোনো কার্যক্রম নেই। শিশুদের জন্য সুস্থ বিনোদনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হবে আমাদেরই। বাচ্চাদের খেলার মাঠ দিতে হবে। সামাজিকভাবে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। অধ্যাপক ডা. জিল্লুর রহমান খান রতন মনে করেন, ধর্মীয় মূল্যবোধ এখানে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শিশুদের যদি ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসী করে বড় করা যায়, তাহলে তাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতাও কমে যাবে। আর ধর্মচর্চার মাধ্যমেই এ ধরনের অপরাধ নির্মূল সম্ভব।
দেশের অর্ধেক ইন্টারনেট ব্যবহৃত হচ্ছে পর্নোগ্রাফি ও খারাপ অ্যাপসে দেশে বর্তমানে ব্যবহৃত ইন্টারনেটের অর্ধেকই খরচ হচ্ছে পর্নোগ্রাফি, টিকটক, ফ্রি-ফায়ার কিংবা পাবজির পেছনে। জাতীয় প্রেস ক্লাবে গত ৪ সেপ্টেম্বর নিরাপদ ইন্টারনেট বিষয়ক এক অনুষ্ঠানে উঠে আসে উদ্বেগজনক এমন তথ্য। তবে বিটিআরসি বলছে, ফ্রি-ফায়ার-পাবজির পর টিকটক-লাইকির মতো অ্যাপ বন্ধের প্রক্রিয়া চলছে। সবার জন্য নিরাপদ ইন্টারনেট নিশ্চিতে আইন করার কথাও ভাবা হচ্ছে। করোনাকালে দেশে হঠাৎ করে আলোচনায় টিকটক ও লাইকি। এসব অ্যাপে তারকা বানানোর প্রলোভন দেখিয়ে নারী পাচারসহ নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডে দেশজুড়ে শুরু হয় তোলপাড়। ফ্রি-ফায়ার ও পাবজির মতো অনলাইন গেম কিশোর-তরুণদের আগ্রাসী করে তুলছে বলে নানা মহল থেকে অভিযোগ ওঠার পর বন্ধ করা হয়েছে এগুলো। বন্ধ করা হয়েছে ২০ হাজারের বেশি পর্নো সাইটও। ৪ জানুয়ারী জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক অনুষ্ঠানে ইন্টারনেট সেবাদাতাদের সংগঠন আইএসপিএবির সাধারণ সম্পাদক এমদাদুল হক দাবি করেন, বর্তমানে দেশে ব্যবহৃত ২৬শ’ জিবিপিএস ব্যান্ডউইথের অর্ধেকই ব্যয় হচ্ছে ভার্চুয়াল গেম, টিকটক, লাইকি ও পর্নোগ্রাফি দেখার পেছনে। তিনি বলেন, শতকরা ৫০ শতাংশই ব্যবহার হচ্ছে পর্নো, গেমিং বুলিংয়ে। প্রেস ক্লাবের ওই সভা থেকে জানানো হয়, বর্তমানে দেশে মুঠোফোন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১১ কোটি ৩৬ লাখ। আর ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন এক কোটি গ্রাহক। এই বিশালসংখ্যক মানুষ যদি পর্নো আর গেম নিয়ে পড়ে থাকে, তাহলে একটা সময় এই সমাজের অবস্থা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা নিয়ে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার অন্ত নেই।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নৈতিক শিক্ষার সুযোগ নেই, তাইৃ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নৈতিক শিক্ষা সুযোগ না থাকার কারণে শিক্ষার্থীরা সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত হয় ঠিকই, কিন্তু তারা সমাজ ও কর্মস্থলে নৈতিকতা মেনে চলে না। ফলে সমাজে সুদ-ঘুষ চলে অহরহ। এসব সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিতরা কর্মস্থলে সততার পরিচয় দিতে পারেন না। নারী সহকর্মীরা তাদের নিয়ে টেনশনে থাকেন। কাজে ফাঁকি দিয়ে অন্যকাজে সময়ক্ষেপণ করেন। দুই বছর আগের ঘটনা, সম্ভবত গত সালের জুলাই মাসের তৃতীয় সপ্তাহে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সেমিনারে কথাশিল্পী আনিসুল হক একবার বলেছিলেন, বুয়েটের কোনো এক অনুষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞেস করা হয়েছিল চাকরি জীবনে তাদের মধ্যে কে কে ঘুষ খাবে?
উত্তরে ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী হাসতে হাসতে হাত তুলে বলেছিল, তারা ঘুষ খাবে। ৩-৪ শতাংশ ইতস্তত করছিল অর্থাৎ তারা ঘুষ খেতেও পারে আবার নাও খেতে পারে। বোঝা যাচ্ছে, সুযোগ পেলে তারাও হয়তো ঘুষ হাতছাড়া করবে না। ধরে নেওয়া হয়, দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীরাই বুয়েটে পড়ার সুযোগ পায়, তারাই যদি ঘুষ নেওয়ার মতো গর্হিত কাজকে স্বাভাবিক মনে করে, তাহলে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে আমরা তাদের কী শিক্ষা দিচ্ছি? বিশ্লেষকরা বলছেন, মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে বড় পার্থক্য হলো, মানুষ নৈতিকতাসম্পন্ন জীব, অন্য প্রাণী তা নয়। ন্যায় আর সত্যের পথ অনুসরণ করে অন্যের ক্ষতি না করে যতটুকু সম্ভব উপকার করা, অপরের কল্যাণ করা প্রতিটি নৈতিকতাসম্পন্ন মানুষের কাজ। পবিত্র ইসলাম ধর্মসহ প্রতিটি ধর্মেই তাই নৈতিকতার কথা বলা হয়েছে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে। কারণ নৈতিকতাবিহীন মানুষ ধর্মীয় কাজ করে কী করবেন? অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানরা নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন; বিশেষ করে শিক্ষকরা যখন নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগে অভিযুক্ত হন, তখন এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে শিক্ষার্থীদের ওপর। মেয়েদের সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য দেশের সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষক পরিমলের যৌন কেলেঙ্কারির ঘটনায় দেশজুড়ে ছিঃ ছিঃ করছিল মানুষ এখনো পরিমলকাণ্ড ভুলে যায়নি। এই প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের নানা কেলেঙ্কারির পর সম্প্রতি বর্তমান অধ্যক্ষের একটি অডিও প্রকাশ পাওয়ার পর তা দেশজুড়ে ভাইরাল হয়েছে। স্বনামধন্য এমন একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানের মুখের ভাষা শুনে শুধু সচেতন অভিভাবকরাই নন, শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষই হতবাক। এসব কারণে শিক্ষার্থীর মনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তাছাড়া ৪৫ শতাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয় না। ৭০ শতাংশ বিদ্যালয়ে স্কাউটিং হয় না। অনেকের বিপথে যাওয়ার যাত্রা এখান থেকেই শুরু হয়। একজন মানুষ অবৈধ অর্থ কেন নেবেন না, সে বিষয়ে তার কোনো শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ আছে কি? নেই। অবৈধ অর্থ না নেওয়ার শিক্ষা শিক্ষার্থী কোথায় পাবে? বিশ্লেষকরা বলছেন, অর্থনৈতিক সূচকে বাংলাদেশ যতটুকু এগিয়েছে, সামাজিক সুরক্ষা, দুর্নীতি দমন ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তেমন অগ্রগতি হয়নি। বরং সামাজিক সুরক্ষা ও সুশাসনের চরম অবনতি ঘটেছে। পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে দুর্নীতি। ফলে অশান্তি ও নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি হয়েছে, যা টেকসই উন্নয়নের প্রধান অন্তরায়।
জন্মের পরপরই ধর্মচর্চায় আগ্রহী করতে হবে একজন শিশু জন্ম নেওয়ার আগেই বাবা-মাকে সিদ্ধান্ত নিয়ে রাখতে হবে এই সন্তানকে তারা কেমন সন্তান হিসেবে গড়ে তুলতে চান। আর সেই পরিকল্পনার আলোকেই ওই সন্তানকে বেড়ে ওঠার সুযোগ করে দিতে হবে। অভিজ্ঞরা বলছেন, ধর্মচর্চার কোনো বিকল্প নেই। জন্মের পরক্ষণেই সন্তানের কানে একত্ববাদের বাণী শোনাতে হবে মাতা-পিতাকে। হজরত আবু রাফে থেকে বর্ণিত, আমি নবী করীমকে (সা.) দেখেছি, মা-ফাতিমা রা.-এর গর্ভে হজরত হাসান রা. জন্মগ্রহণ করলে তার কানে নামাজের আজানের মতো আজান দিয়েছেন, (তিরমিযী, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা-১৮৩)। মহানবী আরো বলেন, যখন তোমাদের সন্তানরা কথা বলতে শেখে, তখন তাদের কালেমা, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ শিক্ষা দাও (বায়হাকী)। মহানবী সা. এ-ও বলেছেন, আল্লাহর গুণবাচক নামের সাথে মিলিয়ে সন্তানদের নাম রাখো। শিশুর জন্মের সপ্তম দিন আকিকা করা নবীর সুন্নত। রাসূল সা. বলেছেন, ছেলের জন্য দুটি ছাগল এবং মেয়ের জন্য একটি ছাগল আকিকা করবে (বায়হাকী)। মাতা-পিতার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ হক হলো পুত্রসন্তানের খতনার ব্যবস্থা করা। এটি সুন্নতে ইবরাহীমি। আনুষঙ্গিক এসব কাজ শেষ করার পর সন্তানদের প্রাথমিক শিক্ষা হিসেবে ধর্মীয় শিক্ষায় সুশিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে। এটাই জীবন পরিচালনার মূলগত ভিত্তি বা কাঠামো। ইসলামের ৫টি স্তম্ভ, ঈমান, নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত এসব কর্ম যাতে করে সন্তানদের মধ্যে শিশু বয়স থেকে প্রতিফলিত হয়, সেই প্রচেষ্টা বাবা-মাকে চালিয়ে যেতে হবে। এভাবে যদি একটি শিশু সন্তানকে (১-১৮ বছর) প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তোলা যায়, তাহলে সেই সন্তান পিতা-মাতার কাছে আকাশছোঁয়া স্বপ্নের মতো মনে হবে। শিশু বয়সে ধর্মীয় শিক্ষা দেয়ার পর পরবর্তী সময়ে সন্তানদের ইংরেজি বা বাংলায় যতই উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে গড়ে তোলা হোক না কেন, সমাজের জন্য সে হিতকর বার্তাই বয়ে আনবে।
মানুষের মাঝে নৈতিক ও মানবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটানো খুবই জরুরি। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিকতা ও মানবিক গুণাবলি গড়ে তুলতে হবে। এতে পরিবারকে মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে। কারণ পরিবারেই এসবের বীজ প্রোথিত হয়। এছাড়া সামাজিক পরিবেশ দেখে শিশুরা অনেক কিছু শেখে। এজন্য সমাজকে গুরুদায়িত্ব পালন করতে হবে। শিক্ষকরা ছাত্র-ছাত্রীদের প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলেন। সামাজিক কৃষ্টি-কালচার, রীতি-নীতিও শিক্ষার্থীদের মূল্যবোধ সৃষ্টিতে প্রভাব ফেলে। তাই প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত শিক্ষার সকল স্তরে নিয়মিত ধর্মীয় কৃষ্টি-কালচার বিষয়ক অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করতে হবে। এতে শিক্ষার্থীদের মাঝে সামাজিক দায়িত্ববোধ ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ সম্পর্কে একটি শক্ত ভিত গড়ে উঠবে। ফলে তারা বিপথগামী হওয়া থেকে বিরত থাকবে। সেইসঙ্গে তাদের মননশীলতার বিকাশ ঘটবে। এছাড়া মূল্যবোধ সৃষ্টিতে ধর্মীয় জ্ঞান বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। ধর্মের প্রকৃত পাঠই শিক্ষার্থীদের নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে। এক্ষেত্রে ধর্মের অপব্যাখা দিয়ে কেউ যাতে শিক্ষার্থীদের ভুল পথে পরিচালিত করতে না পারে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। পরিবারই হচ্ছে মানুষ হওয়ার প্রথম শিক্ষাগার।
পৌরনীতির ভাষায়, ‘পরিবারকে বলা হয় মানবিক গুণাবলি অর্জনের প্রথম শিক্ষাগার’। যেখানে একজন ছেলে বা মেয়ে বড়দের শ্রদ্ধা করা ও ছোটদের স্নেহ করার শিক্ষা পায়। পরিবারই হচ্ছে এক্ষেত্রে প্রথম ধাপ। বড় হওয়ার প্রক্রিয়ায় পরিবারের গণ্ডির বাইরে ছেলে-মেয়েরা যখন তাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থার সঙ্গে মেশে, তখন তারা আরও বেশি শেখার সুযোগ পায়। সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে শিশুরা নানা ধরনের মানুষের সঙ্গে মেশে। এর ফলে অন্যদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে তাদের মধ্যে নানা নৈতিক ও মানবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটে। এরপর তারা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও জ্ঞানার্জনের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয় যা নৈতিক ও মানবিক গুণাবলি অর্জনের অনেক বড় একটা পরিধি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একটি গণ্ডির মধ্যে হলেও শিক্ষার্থীরা এখান থেকেই জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা পায়। কারণ শিক্ষকরা জীবনের নানা বিষয়ে শিক্ষার্থীদের শেখানোর ও বোঝানোর চেষ্টা করেন। শিক্ষার্থীদের মাঝে দেশপ্রেম জাগিয়ে তোলা, সমাজের প্রতি দায়িত্ব্-কর্তব্য কী, তা তাদের জানানো-শেখানো; সর্বোপরি মানুষ গড়ার কারিগর কিন্তু শিক্ষকরাই। অনেক সময় দেখা যায়, বাবা-মার কথা হয়তো শিক্ষার্থীরা শুনছে না, কিন্তু একজন শিক্ষকের কথার প্রতি তারা বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। তাই শিক্ষার্থীদের মাঝে নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ববোধ জাগ্রত করার ক্ষেত্রে শিক্ষকরাই বড় ভূমিকা পালন করছেন। বিশ্লেষকরা বলছেন, পরিবারই শিশুর প্রথম পাঠশালা। বাবা-মা-ই প্রথম শিক্ষক। এদের কাছ থেকেই শিশুরা প্রাথমিক পাঠ পেয়ে থাকে। তাই পরিবারগুলো নৈতিকতা শিক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা না নিয়ে সমাজের অবস্থা ক্রমেই খারাপের দিকে যাবে।
লেখক- গবেষক, কলামিস্ট, মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান,সিলেট।