বড়লেখার এক দ্বিতল ভবনে বইয়ের আলোয় আলোকিত যুবসমাজ

0
219

আফজাল হোসেন রুমেল, বড়লেখা প্রতিনিধিঃ মৌলভীবাজারের বড়লেখার দক্ষিণভাগ (দ.) ইউনিয়নের বইপ্রেমী কিছু যুবক। নিজেরা অর্থ সংগ্রহ করে প্রতিষ্ঠা করেছে একটি গণগ্রন্থাগার ও সংগ্রহশালা। নাম দিয়েছে ‘দক্ষিণভাগ গণগ্রন্থাগার ও সংগ্রহশালা’। ইতিমধ্যে এলাকায় এটি ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। এলাকার যুবক ও কিশোররা একসময় যখন মোবাইলে ডুবে থাকতো এখন তারা গ্রন্থাগারে গিয়ে বই পড়ায় ঝুঁকছে। অনেকে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছেন পড়ার জন্য। প্রতিদিন অন্তত ২০-২৫ জন যুবক গ্রন্থাগারে গিয়ে বই পড়ছেন।

আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির যুগে শিশু কিশোর, যুবক, বৃদ্ধ, সবাই যখন স্মার্ট ফোন, কম্পিউটার আর ল্যাপটপে আসক্ত তখন একটু বই পড়ার সময় কই! আগেকার যুগের মানুষ অবসরে বই নিয়ে বসতো আর বর্তমান যুগের মানুষ দিনের বেশিরভাগ সময়ই মোবাইলের স্ক্রিনে চোখ বোলাতে ব্যস্ত থাকে। ফেসবুকের নিউজ ফিডে পড়ে থাকে ঘন্টার পর ঘন্টা। দিনকে দিন সবাই যেন বই বিমুখ হয়ে যাচ্ছে। ঠিক সেই সময়ে এলাকার মানুষকে বইমুখি করতে বইপ্রেমী যুবকদের এটি চমৎকার উদ্যোগ।

সরেজমিন গ্রন্থাগারে গিয়ে দেখা যায়, দক্ষিণভাগ বাজারের দক্ষিণ পাশেই অন্তর্মুখী সৌন্দর্য নিয়ে দ্বিতল ভবন বিকেলের রোদে হাসছে। ভবনের দেয়ালে ইটের চকচক করা অহংকার নেই। ভবনের ভেতরেও দামি আসবাব নেই। আছে অন্য রকম কিছু, যা নীরবে মনের সৌরলোকে আলো জোগায়। জানার জগৎকে সমৃদ্ধ করে, আলো ছড়ায় মানব থেকে মানবে। সেখানে আছে সে রকম এক অমূল্য সম্পদের সময়, বই। নানা বিষয় বৈচিত্রের বই।

এ বইয়ের দুনিয়া তৈরি হয়েছে সরেজমিনে মুদচ্ছির ম্যানসনের দ্বিতীয় তলায় একটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে গণগ্রন্থাগার ও সংগ্রহশালাটি চালু করা হয়েছে। গ্রন্থাগার কক্ষের চারপাশের তাকে তাকে সাজিয়ে রাখা হয়েছে উপন্যাস, নাটক, কবিতা, গল্প, ইতিহাস, দর্শন, রাজনীতিসহ বিভিন্ন ধরনের বই। আলাদা আলাদা তাকে এগুলো স্থান পেয়েছে। রয়েছে ধর্মীয় গ্রন্থ কোরআন, গীতা, বাইবেল ও ত্রিপিটক। স্থানীয় লেখকদের বইও স্থান পেয়েছে আলাদা একটি তাকে। বইপ্রেমীরা যাতে বসে বই বড়তে পারেন সেজন্য রয়েছে একটি টেবিল ও অনেকগুলো চেয়ার। এছাড়া গ্রামাঞ্চলের হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য ধরে রাখতে গ্রন্থাগারের একপাশে রাখা হয়েছে পুরনো কাঠের খড়ম, আগেকার দিনের দেশি ও বিদেশি ধাতব মুদ্রা, কুপি বাতি ও হারিকেন। এসব দেখতে দর্শনার্থীরাও আসছেন।

মাঝে মাঝে এলাকার লেখক ও স্থানীয় সাহিত্যমনা তরুণদের নিয়ে গ্রন্থাগারে আয়োজন করা হয় সাহিত্য আড্ডার। গল্পে আড্ডায় সাহিত্যের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করেন আলোচকরা। চলতি বছরে পালন করা হয়েছে নজরুল জয়ন্তী। আয়োজন করা হয় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সভার। সভায় দুই জন মুক্তিযোদ্ধা শুনিয়েছেন তাদের যুদ্ধকালীন নানা গল্প। এমনটাই জানান গ্রন্থাগারের উদ্যোক্তারা।

উদ্যোক্তা কামরুল ইসলাম জানান, গত ৫ মে গণগ্রন্থাগার ও সংগ্রহশালাটি উদ্বোধন করা হয়। এই মুহুর্তে ১২ শতাধিক বই রয়েছে। প্রতিদিন কেউ না কেউ গ্রন্থাগারের জন্য বই উপহার দিয়ে যাচ্ছেন। স্থানীয় লেখকদের প্রায় ৫০ টি বই রয়েছে। প্রতিদিন দুপুর ২ টা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত গ্রন্থাগারটি খোলা থাকে। দেখাশোনার জন্য একজন লোক রয়েছেন বলেও জানান তিনি। গ্রন্থাগারে এ পর্যন্ত আড়াই লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে।

গ্রন্থাগারের আরেক উদ্যোক্তা লন্ডন প্রবাসী সাংবাদিক সাহিদুল ইসলাম বলেন ‘এলাকার বইবিমুখ মানুষকে বইমুখি করতে আমরা এই উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। ছোট পরিসরে যাত্রা শুরু করলেও আমাদের স্বপ্ন বিশাল। ইচ্ছে আছে অদূর ভবিষ্যতে নিজস্ব জায়গা কিনে সেখানে বড় পরিসরে গ্রন্থাগার পরিচালনার। আমাদের সংগ্রহশালায় গ্রাম বাংলার হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যবাহী জিনিসগুলো সংগ্রহ করে রাখবো। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যাতে অতীত সম্পর্কে জানতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা গ্রন্থাগারে দেশি লেখকের বইয়ের পাশাপাশি বিদেশি লেখকদের বইও রাখবো। যাতে পাঠকেরা সব ধরনের বই পড়তে পারে। আমি ইতিমধ্যে লন্ডনে ৪০০ বই সংগ্রহ করেছি। কার্গোর মাধ্যমে সেগুলো দেশে পাঠাবো।’

বড়লেখা সরকারি কলেজের সহকারী অধ্যাপক নিয়াজ উদ্দীন জানান, ‘মানুষ দিন দিন আধুনিক ডিভাইসের প্রতি যেভাবে ঝুঁকছে তাতে তারা বইপড়া থেকে সরে যাচ্ছে। এই সময়ে গ্রন্থাগারটি চালু চমৎকার উদ্যোগ। আমি উদ্যোক্তাদের সাধুবাদ জানাই। গ্রন্থাগারটি চালুর পাশাপাশি এর প্রচার ও প্রসার ঘটাতে হবে। আমার মনে হয় যদি এই গ্রন্থাগারের উদ্যোক্তারা মাঝে মাঝে এলাকার শিক্ষার্থী, পাঠক ও লেখকদের নিয়ে সাহিত্য আড্ডার আয়োজন করলে গ্রন্থাগারের প্রচার বাড়বে, তৈরি হবে পাঠক শ্রেণীর।