যুদ্ধাপরাধ মামলায় কায়সারের ফাঁসির আদেশ

    0
    137

    আমারসিলেট24ডটকম,২৩ডিসেম্বরঃ ১৯৭১ সালের মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধ মামলার রায়ে সাবেক এরশাদ সরকারের প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

    বিচারপতি ওবায়দুল হাসান নেতৃত্বাধীন ৩ সদস্যের বিচারিক প্যানেল আজ মঙ্গলবার এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ১৬৬১ প্যারার ৪৮৪ পৃষ্ঠার রায়ের সার সংক্ষেপ পড়া শেষে এ আদেশ দেন।

    এ রায়ে ১৪টি অভিযোগ প্রমানিণ হয়েছে। ১৬টি অভিযোগের মধ্যে ৪ ও ১৫ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। বিচারক প্যানেলের অপর ২ সদস্য হলেন- বিচারপতি শাহিনুর ইসলাম ও বিচারপতি মোঃ মুজিবুর রহমান মিয়া। কায়সারের মামলায় উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক পেশের পর গত ২০ আগস্ট রায় যে কোন দিন ঘোষণার (সিএভি) আদেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল। ওইদিন কায়সারের জামিন বাতিল করে তাকে কারাগারে পাঠানোরও নির্দেশ দেয়া হয়।
    এর আগে সাক্ষ্য জেরা ও দুই পক্ষের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে গত ২০ আগস্ট মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখা হয়। অপেক্ষমাণ রাখার ৪ মাস ২ দিন পর মঙ্গলবার এ মামলার রায় হলো। এটি হচ্ছে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার ১৪তম রায়। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের দুটি বেঞ্চে এর আগে ১৩টি মামলার রায় হয়েছে। সাবেক এ প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ১৬টি অভিযোগ এনেছে প্রসিকিউশন।
    প্রসিকিউটর রানা দাশগুপ্ত আসামি কায়সারের বিরুদ্ধে সবগুলো অভিযোগ প্রমাণে সক্ষম হয়েছে দাবি করে তার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড প্রার্থনা করেন। পাশাপাশি তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় কায়সারের অপরাধের শিকার ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ক্ষতিপূরণ দাবি করেন। তিনি বলেন, ৪২ বছর আগে মুক্তিযুদ্ধের সময় কায়সার ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জসহ বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে অপরাধ সংঘটিত করে। সচেতনভাবে, সুপরিকল্পিতভাবে এ আসামি অপরাধ করে। তখন সে ২৮ বছরের যুবক ছিল। সে সময় ‘ড্রাগনের’ ভূমিকা পালন করেছিল এ আসামি। তিনি আরও বলেন, অভিযুক্ত কায়সারের বিরুদ্ধে মোট ১৬টি অভিযোগ আনা হয়েছে।

    আসামিপক্ষ একটি অভিযোগও অস্বীকার করে নি। কায়সারের বাবা ও মামা ১৯৬৫ সালে প্রাদেশিক সরকারের সদস্য ছিলেন এবং তার বাবা এবং মামার প্রভাবে এলাকার সকলে তাদের পরিবার ও কায়সারের ভয়ে তটস্থ ছিল।
    কায়সারের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
    অভিযোগ ১ : একাত্তরের ২৭ এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া (তৎকালীন কুমিল্লা মহকুমা) সদরের পুলিশ ফাঁড়ি ও ইসলামপুর গ্রামের কাজীবাড়িতে শাহজাহান চেয়ারম্যানকে হত্যা, নায়েব আলী নামের একজনকে জখম ও লুটপাট করে কায়সার ও তার লোকজন।
    অভিযোগ ২: একই দিনে হবিগঞ্জ জেলার (তৎকালীন মহকুমা) মাধবপুর বাজারের পশ্চিমাংশ ও পার্শ্ববর্তী কাটিয়ারায় লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে সৈয়দ কায়সার ও তার লোকজন। এ সময় কামিনী রায়, বিনোদ বিহারী মোদক, শচীন্দ্র রায়, হীরেন্দ্র রায়, রতি বাবু, অহিদ হোসেন পাঠানের দোকানসহ প্রায় ১৫০টি বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
    অভিযোগ ৩: একই দিনের  হবিগঞ্জ জেলার (তৎকালীন মহকুমা) মাধবপুর থানার কৃষ্ণনগর গ্রামের অহিদ হোসেন পাঠান, চেরাগ আলী, জনাব আলী ও মধু সুইপারকে হত্যা করে কায়সার ও তার লোকজন। তাদের বাড়িঘরে লুটপাট করার পর আগুন দেয় তারা।
    অভিযোগ ৪: পরদিন ২৮ এপ্রিল সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী হবিগঞ্জের মাধবপুর বাজারের উত্তর পূর্ব অংশে লুটপাট, অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় তারা পূর্ব মাধবপুরের আবদুস সাত্তার, লালু মিয়া ও বরকত আলীকে হত্যা করে এবং কদর আলী জখম করে।
    অভিযোগ ৫: একাত্তরের ২৯ এপ্রিল দুপুর থেকে বিকালের মধ্যে হবিগঞ্জ সদরের শায়েস্তাগঞ্জ খাদ্যগুদাম এবং শায়েস্তাগঞ্জ পুরান বাজারের রেলব্রিজ এলাকায় আবদুল আজিজ, আবদুল খালেক, রেজাউল করিম, আবদুর রহমান এবং বড়বহুলা এলাকার আবদুল আলী ওরফে গ্যাদা , লেঞ্জাপাড়া এলাকার মাজত আলী ও তারা মিয়া চৌধুরীকে আটক করে নির্যাতনের পর হত্যা করে সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী।
    অভিযোগ ৬: একাত্তরের ২৯ এপ্রিল সন্ধ্যার পর হবিগঞ্জ সদরের পুরানবাজার পয়েন্টে সাবেক বিচারপতি সৈয়দ এ বি এম মহিউদ্দিনের বাড়িতে হামলা হয়। এছাড়া লস্করপুর রেল লাইনের পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে সালেহ উদ্দিন আহমেদ এবং হীরেন্দ্র চন্দ্র রায়কে ধরে নিয়ে নির্যাতনের পর হত্যা করে সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী।
    অভিযোগ ৭: সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী ৩০ এপ্রিল হবিগঞ্জ সদরের এনএনএ মোস্তফা আলীর বাড়িসহ ৪০/৫০টি বাড়িঘর, দোকানপাটে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করে।
    অভিযোগ ৮: একাত্তরের ১১ মে হবিগঞ্জের চুনারুঘাট থানার চাঁদপুর চা বাগানে সাঁওতাল নারী হীরামণিকে ধর্ষণ করে সৈয়দ কায়সারের বাহিনী। সৈয়দ কায়সার এ সাঁওতাল নারীকে ধর্ষণে সহায়তা ।
    অভিযোগ ৯: একাত্তরের ১৫ মে হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুরের লোহাইদ এলাকার আবদুল আজিজ, আবদুল গফুর, জমির উদ্দিন, আজিম উদ্দিন, এতিমুনেছা, নূর আলী চৌধুরী, আলম চাঁনবিবি ও আবদুল আলীকে হত্যা করে সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী। ওইদিন আকরাম আলী চৌধুরী নামে একজনকে জখমও করেন সৈয়দ কায়সার।
    অভিযোগ ১০: এরপর ১৩ জুন হবিগঞ্জ সদর, মোকাম বাড়ি, শায়েস্তাগঞ্জ থানার আর অ্যান্ড এইচ ডাকবাংলো এবং মাধবপুর থানার শাহাজীবাজার এলাকার হামলা চালায় সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী। এ সময় শাহ ফিরোজ আলী নামের একজনকে অপহরণের পর নির্যাতন করে হত্যা করা হয়। সাবু মিয়া নামের আরেকজনকে অপহরণের পর চালানো হয় নির্যাতন।
    অভিযোগ ১১: একাত্তরের ২৩ জুন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার হরিপুর থানার নাসিরনগরের গোলাম রউফ  ও তার পরিবারের লোকজনদের উপর নির্যাতন চালায় সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী। এছাড়া গোলাম রউফকে অপহরণ ও আটকের পর তার উপর নির্যাতন চলে। এক পর্যায়ে মুক্তিপণ আদায় করে তার বাড়িঘরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। এছাড়া একই দিনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর থানার দয়াল গোবিন্দ রায় ওরফে বাদল কর্মকারের বাড়িতে হামলা চালায় সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী। লুটপাটের পর ওই বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়।
    অভিযোগ ১২: সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী আগস্ট মাসের মাঝামাঝি কোনো একদিন হবিগঞ্জের মাধবপুর থানার বেলাঘর ও জগদীশপুর হাইস্কুল থেকে আতাব মিয়া, আইয়ুব মিয়া, মাজেদা বেগমকে অপহরণ করে। এক পর্যায়ে মাজেদাকে ধর্ষণ করা হয়।
    অভিযোগ ১৩: একাত্তরের ১৮ আগস্ট হবিগঞ্জের নলুয়া চা বাগান থেকে মহিবুল্লাহ, আবদুস শহীদ, আকবর আলী, জাহির হোসেনকে অপহরণ করে নরপতিতে আবদুস শাহীদের বাড়ি ও রাজেন্দ্র দত্তের বাড়িতে স্থানীয় শান্তি কমিটির কার্যালয় এবং কালাপুরের পাকিস্তানি সেনা ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতনের পর হত্যা করে সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী।
    অভিযোগ ১৪: একাত্তরের ২৯ সেপ্টেম্বর  হবিগঞ্জের মাধবপুরে সোনাই নদীর ব্রিজ এলাকা থেকে সিরাজ আলী, ওয়াহেদ আলী, আক্কাস আলী, আবদুল ছাত্তারকে অপহরণ করে নিয়ে যায় সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী। তাদের আটকে রেখে নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়।
    অভিযোগ ১৫: অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি কোনো একদিন সন্ধ্যায় হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুরে শালবন রঘুনন্দ পাহাড় এলাকায় শাহাপুর গ্রামের নাজিম উদ্দিনকে অপহরণের পর আটকে রেখে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়।
    অভিযোগ ১৬: সৈয়দ কায়সার ও তার বাহিনী ১৯৭১ সালের ১৫ নভেম্বর ব্রাহ্মণবড়িয়ার ভাটপাড়া থানার দাউরা, নিশ্চিন্তপুর, গুটমা, বুরুঙ্গা, চিতনা, নূরপুর, ফুলপুর, জেঠাগ্রাম, পাঠানিশা, কুলিতুণ্ডা, আন্দ্রাবহ, তিলপাড়া, কমলপুর, গঙ্গানগর, বাঘি, শ্যামপুর, কুয়ারপুর, নোয়াগাঁও, কুণ্ডা, লক্ষীপুর, করগ্রাম গ্রামের ১০৮ জনকে হত্যা করে।
    প্রসঙ্গত সৈয়দ কায়সারের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গত ২ ফেব্রুয়ারি অভিযোগ গঠন করা হয়। তার বিরুদ্ধে গণহত্যার একটি, হত্যা, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠনের ১৪টি এবং ধর্ষণের দুটিসহ মোট ১৬টি মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ আনা হয়। গত বছরের ১৪ নভেম্বর তার বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেয়া হয়।

    গত বছরের ৫ আগস্ট শর্তসাপেক্ষে জামিন পেয়ে কায়সার রাজধানীতে তার ছেলের বাসায় ছিল। কায়সার হচ্ছে ২য় কোনো আসামি যে শর্তসাপেক্ষে জামিন পায়। এর আগে বিএনপি নেতা আব্দুল আলীমও শর্তসাপেক্ষে জামিন পেয়েছিলেন।