শিক্ষা খাতে বিপর্যয় জাতির জন্য অশনি সংকেত

    0
    132

    আমারসিলেট24ডটকম,১৮নভেম্বর,লুৎফুর রহমান তোফায়েলকোনো জাতির সমৃদ্ধির প্রধান এবং প্রথম হাতিয়ার হচ্ছে শিক্ষা। তাই খুব প্রচলিত একটি কথা আছে, ‘যে জাতি যত শিক্ষিত, সে জাতি তত উন্নত’। অগ্রসরমান এই পৃথিবী তা-ই দৃশ্যমান। চলতি বিশ্বে যে জাতি জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ও বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে যত এগিয়ে তারাই আজ বিশ্বে তত বেশি প্রভাব প্রতিপত্তি ও সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে।

    ব্যক্তিগতভাবেও শিক্ষা মানুষকে আলোকিত করে। মানবিক গুণাবলীর বিকাশ ঘটায়। এর মাধ্যমে সমাজ-রাষ্ট্র সুন্দর-সুশৃঙ্খল-সমৃদ্ধ হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশর শিক্ষাব্যবস্থার চালচিত্র খুবই নাজুক। শিক্ষার মান নিয়ে বোদ্ধা মহলে বারবার নানা প্রশ্ন ও সমালোচনার সৃষ্টি হচ্ছে।

    পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস এবং অস্বাভাবিক পাশের হার ও জিপিএ-৫ প্রাপ্তি ভাবিয়ে তুলেছে দেশের সুশীল সমাজকে। এখানে মেধার সঠিক মূল্যায়ন নিয়ে নানা প্রশ্ন বারবার ঘুরেফিরে আসছে। এই পরীক্ষাগুলোর ফলাফলে যে হারে পাশ এবং জিপিএ-৫ বৃদ্ধি পাচ্ছে ঠিক সেই হারে কি মেধাবী শিক্ষার্থী বেরিয়ে আসছে?

    জিপিএ-৫ এবং পাশের হার বাড়ুক এটা সবাই চায়। কিন্তু দেখতে হবে এই পাশের হার এবং জিপিএ-৫ প্রাপ্তির হারের সাথে শিক্ষার্থীদের মেধার সঠিক মূল্যায়ন এবং বিকাশ হচ্ছে কি না। এই প্রশ্ন তখনই দেখা দেয় যখন এসএসসি-এইচএসসি দুটোতে জিপিএ-৫ নিয়ে কোনো শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়-মেডিকেল কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তির যোগ্যতা অর্জন করতে পারে না! বিষয়টি রীতিমতো উদ্বেগেরও।

    একজন শিক্ষার্থী এসএসসি-এইচএসসি দুই পরীক্ষাতেই জিপিএ-৫ পেল অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় সে পাশ নাম্বারও পেল না। তখন প্রশ্ন জাগে, তাহলে কি আগের পরীক্ষাগুলোতে তার মেধার সঠিক যাচাই হয়নি? দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বর্তমানে তা-ই ঘটছে আমাদের দেশে। এবারের মেডিকেল ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়েরর ভর্তি পরীক্ষা এর প্রমাণ।

    উদাহরণ হিসেবে আনতে পারি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে কলা অনুষদের অধীন ‘খ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে মাত্র দুজন শিক্ষার্থী। অথচ এই বিভাগে ভর্তি হওয়ার কথা ১২৫ জন। ‘ক’ ইউনিটে পাশের হার ২১ দশমিক ৫০ শতাংশ। ‘ঘ’ ইউনিটে পাশের হার ১৬ শতাংশ।

    অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায়ও প্রায় একই চিত্র। সর্বশেষ মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষায় পাশের হার ছিল ৩৪ শতাংশ। ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের এমবিবিএস ও বিডিএস ভর্তি পরীক্ষায় দেশের সব সরকারি-সেরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজে ১০ হাজার ২৯৯টি আসনের বিপরীতে ৬৯ হাজার ৪৭৭ জন পরীক্ষার্থী আবেদন করে।

    এই ৬৯ হাজার ৪৭৭ শিক্ষার্থীর সবাই-ই বিগত দুটি পরীক্ষায় সর্বোচ্চ ফলাফলের অধিকারী। কারণ আমরা জানি, এসএসসি ও এইচএসসিতে যারা সবচে ভালো রেজাল্ট করে তারাই মেডিকেল এবং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেয়।

    তার মানে দেশের সবচে সেরা মেধাবীরাই এই মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেয়। কিন্তু মেডিকেল ও ডেন্টাল ভর্তি পরীক্ষায় তাদের পাশের হার মাত্র ৩৪ শতাংশ। তার মানে বাকি ৬৬ শতাংশ শিক্ষার্থী কি কম মেধাবী? চান্স হয়ত সবাই নাই পেল।

    কিন্তু এখানে পাশের হার এত কম হওয়ার কথা নয়। দেশের সেরা মেধাবীদের এই ফলাফলে প্রমাণিত হয়, তাদের মেধার আগের মূল্যায়নে কোনো ত্রুটি রয়েছে।

    সুশীলসমাজ মনে করেন, পাশের হার বৃদ্ধির সাথে প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টিও নিবিড়ভাবে জড়িত। মোটা অর্থের বিনিময়ে এই প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। সরকারি নথিপত্র অনুযায়ী দেশে সর্বপ্রথম ১৯৭৯ সালে এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের সূচনা হলেও কয়েক বছর ধরে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা পাল্লা দিয়েই বেড়ে চলেছে। ফাঁস হওয়া প্রশ্নে বাড়ছে পাশের হার আর জিপিএ-৫।

    এটি জাতিকে মেধাশূন্য করার পূর্বাভাস। কর্তৃপক্ষ বিষয়টিকে সেভাবে গুরুত্ব সহকারে নিচ্ছেন না। এক পরিসংখ্যানে এসেছে, গত ৩৫ বছরে ৭৮টি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। পরীক্ষা স্থগিত ও বাতিল হয়েছে ১২টিতে। তদন্ত হয়েছে ৩৩টিতে; কিন্তু শাস্তির প্রমাণ নেই। তদন্ত কমিটি গঠন করেই দায়িত্ব শেষ কর্তৃপক্ষের?

    পরীক্ষা মানে তো যোগ্যতা ও মেধা যাচাই। কিন্তু এখন এর পরিবর্তে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে অর্থ কামাই করার নানা ফন্দি চলে। এতে তুলনামূলক কম মেধাবীরা ভালো রেজাল্ট করছে আবার কখনো প্রকৃত মেধাবীরা পেছনে পড়ে যাচ্ছে। এর প্রভাবে অনেক মেধাবী মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছে। তারা পড়াশোনার উৎসাহ হারিয়ে ফেলছে।

    পাশের হার বৃদ্ধির আরেকটি কারণ, পরীক্ষকদের কাছে অলিখিত নির্দেশনা আছেÑ যতটা সম্ভব ছাত্রছাত্রীদের পাশ করিয়ে দিতে হবে। একটা প্রশ্নের আংশিক উত্তর লিখলেও পুরো নম্বর দিতে হবে। তাই পরীক্ষকেরা সঠিকভাবে খাতা মূল্যায়ন না করে শুধু নাম্বারই দিতে থাকেন। এতে পাশের হার বাড়ছে, জিপিএ-৫ বাড়ছে ঠিক; কিন্তু কমছে শিক্ষার মান।

    ইতোমধ্যে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে দেশে-বিদেশে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। বাংলাদেশের শিক্ষার গুণগত মান খুবই হতাশাব্যঞ্জক বলে সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে। পরীক্ষায় নকল যেভাবে হ্রাস পেয়েছে অনুরূপভাবে প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

    এছাড়া খাতা মূল্যায়নে শিক্ষার্থীর মেধা ও যোগ্যতা যাচাইয়ের দিকটি মাথায় রাখতে হবে পরীক্ষকদের। তা না হলে শতভাগ পাশ আর জিপিএ-৫ পাওয়ার যতই প্রচারণা চালানো হোক না কেন এর আড়ালে যে কয়েকটি প্রজন্ম নূন্যতম যোগ্যতা নিয়ে বেড়ে উঠতে ব্যর্থ হবে।

    গণপাশ, জিপিএ-৫ ও গোল্ডেন জিপিএ-৫ পাওয়ার প্রতিযোগিতার পরিবর্তে শিক্ষার্থীরা জানতে ও শিখতে পারছে কি না তা যাচাই করা দরকার। এটাই জাতি গঠনে আমাদের কাজে আসবে।লেখকঃপ্রাবন্ধিক,কলামিস্ট।