হামাসের হামলায় ইসরাইলের অভ্যন্তরে আতঙ্ক: হামলা পাল্টা হামলায় উভয়পক্ষের সাড়ে ৯ শতাধিক লোকের মৃত্যু!

0
167

আমার সিলেট ডেস্ক: ফিলিস্তিনি সশস্ত্র প্রতিরোধ যোদ্ধাগোষ্ঠী হামাস এবং দখলদার বর্বর ইসরাইলি বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ গতকালও অব্যাহত ছিল।
হামাসের হামলায় ইসরাইলের অভ্যন্তরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লে ইহুদিরা এলাকা ছাড়ছে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়। ইহুদীবাদী সংবাদ মাধ্যম থেকে বিমানবন্দরে ভিড় দেখা যাচ্ছে।
এদিকে হামাস ও ইসাইলের আমলা পাল্টা হামলায় ৬০০ ইসরাইলি ও ৩৭০ জন ফিলিস্তিনিসহ উভয় পক্ষে মোট ৯৭০ জন নিহত হয়েছে।
গত শনিবার হামাস দক্ষিণ ইসরাইলে প্রবেশ, ৫ হাজার রকেট নিক্ষেপ এবং ইসরাইলিদের আটকের করার পর দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ‘একটি দীর্ঘ এবং কঠিন যুদ্ধ’ সম্পর্কে সতর্ক করে দেন।

ইসরায়েলি মিডিয়া হারেৎজ জানিয়েছে, দেশটির দক্ষিণে হামাসের হামলায় ৬০০ জন নিহত, ২,০৪৮ আহত এবং ৭৫০ জন নিখোঁজ হয়েছে। গাজায় ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে, ইসরাইলি হামলায় এ পর্যন্ত ২০ শিশুসহ অন্তত ৩৭০ জন নিহত এবং ২ হাজার আহত হয়েছে। হিজবুল্লাহ লেবানন থেকে উত্তর ইসরাইলে গুলি চালানোর দায় স্বীকার করায় বিরোধ ক্রমশ বাড়ছে।

মূলত আল-আকসা মসজিদের অপবিত্রতা এবং বসতি স্থাপনকারীদের ক্রমবর্ধমান আগ্রাসনের প্রতিক্রিয়ায় শনিবার বড় আকারের হামলা চালায় হামাস। জবাবে দীর্ঘ যুদ্ধের হুঁশিয়ারি দিয়েছে ইসরাইল। ইসরাইলের ১০০ জনকে পণবন্দি করেছে হামাস, গতকাল দ্বিতীয় দিনেও জায়গায় জায়গায় চলেছে গুলির লড়াই। হামাসের সঙ্গে যুদ্ধে বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত গাজায় ইসরাইলের বিমান হামলায় অন্তত ৩৭০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। হামাসের হামলায় এখনও পর্যন্ত প্রাণ গিয়েছে ৬০০ ইসরাইলির। ‘ইসরাইলিরা রোজ যে অত্যাচার করে তার শেষ দেখে ছাড়ব আমরা। তাদের অত্যাচার করার দিন শেষ। পতন আসন্ন। অপারেশন আল আকসা শুরু করেছি আমরা। ২০ মিনিটে ৫ হাজার রকেট ছোঁড়া হয়েছে,’ হামাসের মিলিটারি কমান্ডার মহাম্মদ দিফ বলেন, ‘পৃথিবীর সবচেয়ে বড় যুদ্ধ এবার শেষদিকে গড়িয়েছে।’

গত কয়েক দশক ধরে ফিলিস্তিনিদের ওপর চালানো পাশবিকতার জবাব দিতে ইসরাইলের ওপর হামলা চালাচ্ছে হামাস। শনিবার ইসরাইলে রকেট হামলা শুরু করে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী এই সশস্ত্র সংগঠনটি। আরব ও মুসলিম দেশগুলোকেও যুদ্ধে যোগ দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে হামাস। ‘পশ্চিমতীরে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের’ পাশাপাশি ‘আরব ও মুসলিম দেশগুলোকে’ যুদ্ধে যোগ দেয়ার আহ্বান জানিয়েছে তারা। টেলিগ্রামে পোস্ট করা এক বিবৃতিতে এই আহ্বান জানিয়েছে সংগঠনটি।

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরাকে হামাসের মুখপাত্র খালেদ কাদোমি বলেন, কয়েক দশক ধরে ফিলিস্তিনিরা যেসব নৃশংসতার সম্মুখীন হয়েছেন, তার জবাব দিতেই এই সামরিক অভিযান শুরু করেছেন তারা। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা চাই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় গাজায় নৃশংসতা বন্ধ করুক। ফিলিস্তিনি জনগণ ও আমাদের আল-আকসার মতো পবিত্র স্থান-এসব জিনিস এই যুদ্ধ শুরু করার পেছনের কারণ।’

এদিকে, গতকাল হামাসের সমর্থনে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে মিছিল করছে সব শ্রেণির মানুষ। এ সময় তারা ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের পতাকায় আগুন দিয়েছে। ইরাক, লেবানন, সিরিয়া ও ইয়েমেনে ফিলিস্তিনি পতাকা দুলিয়ে বিক্ষোভ করেছে তারা। ইসরাইলের আঞ্চলিক শত্রু বলে পরিচিত ইরানের পার্লামেন্ট অধিবেশন শনিবার শুরু হয়েছে সদস্যদের ইসরাইল নিপাত যাক ধ্বনির মধ্য দিয়ে। তারা স্লোগান দিতে থাকেন- ইসরাইল ধ্বংস হবে। বিজয়ী হবে ফিলিস্তিন। ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র নাসের কানানি বলেছেন, শনিবারে হামাসের অভিযানে প্রতিরোধের ক্ষেত্রে এবং দখলদারদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভিযানের এক নতুন অধ্যায় সৃষ্টি হয়েছে।

লেবাননে ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবিরগুলোতে শত শত মানুষ হামাসের অপারেশনকে সমর্থন করে রাস্তায় মিছিল করেছেন। বিপুল সংখ্যক মানুষ হামাসের পতাকা হাতে নিয়ে রাজধানী বৈরুতে চক্কর দেন মোটরসাইকেলে। দ্য ইলেকট্রনিক ইনতিফাদা ওয়েবসাইটের সহপ্রতিষ্ঠাতা আলি আবুনিমাহ বলেছেন, ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ইসরাইলের নিষ্পেষণ ও গণহত্যার কারণে ৮০ বছরের মধ্যে শনিবার সহিংস আক্রমণ করা হয়েছে।

বাগদাদ মল নামে একটি শপিং মলেও আলোকিত করা হয় ফিলিস্তিনি পতাকার রঙে। লেখা হয়- আল আকসা ডিল্যুজ। হামাসের অপারেশনের প্রতি সমর্থন দিয়ে এ কথা লেখা হয়। ইরাকের বসরা নগরীতেও হামাসের সমর্থনে র‌্যালি হয়েছে। সেখানে জনতা তাদের গাড়ি চালিয়ে এবং হামাসের, ফিলিস্তিনের পতাকা দুলিয়ে র‌্যালিতে অংশ নেন। তুরস্কের ইস্তাম্বুলে ফাতিহ মসজিদের সামনে সমবেত হন হাজারো জনতা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে দ্রুততার সঙ্গে বলেন, এতে যোগদানকারীরা আরব শরণার্থী। স্থানীয় কেউ নন। ইয়েমেনের তাইজ শহরেও র‌্যালি হয়েছে। এই শহরটি হুতি বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আর হুতিদের সমর্থন দেয় ইরান।
ইরানের রাজধানী তেহরানে ফিলিস্তিন স্কয়ারে সমবেত হন অনেক মানুষ। সেখানে আতশবাজিতে রাতের আকাশ আলোকিত হয়ে ওঠে। ইরানের রাজধানীর আজাদি স্কয়ারে একটি স্মৃতিস্তম্ভকে ফিলিস্তিনি পতাকার রঙে আলোকিত করা হয়। তার ওপর লেখা ওঠে- ক্রিমিনালদের বিরুদ্ধে আমরা প্রতিশোধ নিই। টাইমস অব ইসরাইল বলছে, হামাসের সমর্থনে ফিলিস্তিনের পশ্চিমতীরে শনিবার সন্ধ্যায় বিক্ষোভ করেছেন ফিলিস্তিনিরা। এতে অংশ নেন শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সীরা। তাদের হাতে ছিল ফিলিস্তিনি ও হামাসের পাতাকা। রাস্তায় নেচে-গেয়ে হামাসের প্রতি সমর্থন জানান তারা। একই রকম সমর্থনসূচক র‌্যালি হয়েছে রামাল্লাহ, হেবরন, নাবলুস ও জেনিনে।

ইসরাইলি জেনারেল আটক : হামাসের যোদ্ধাদের অভিযানে গাজা অঞ্চলের জন্য নিযুক্ত সাবেক প্রধান ইসরাইলি সেনা-কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নিমরোদ আলুনি হামাসের মুজাহিদদের হাতে বন্দি হয়েছেন। একটি ছবিতে দেখা গেছে এই জেনারেলকে মাটির ওপর শোয়ানো অবস্থায় টেনে নিয়ে যাচ্ছেন হামাসের যোদ্ধারা। ফিলিস্তিনের গাজার সীমান্তের কাছেই ছিল তার বাসভবন। এই ব্রিগেডিয়ার জেনারেলকে মুক্ত করতে হামাসের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ। অভিযানে কমপক্ষে পঞ্চাশ জন ইসরাইলিকে বন্দি করেছে ফিলিস্তিনি সংগ্রামীরা যাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ইসরাইলি সেনা রয়েছেন এবং অন্যরা অবৈধ ইসরাইলি বসতির বাসিন্দা। ইসরাইলি সেনা ও সাধারণ নাগরিকদের জিম্মি করে হামাস চাইছে, ইসরাইলের কারাগারে যেসব ফিলিস্তিনি বন্দি আছে, তাদের ছেড়ে দেয়া হোক। বন্দিদের অধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন (এনজিও) আদামিরের হিসাব অনুযায়ী, প্রায় ৫ হাজার ২০০ ফিলিস্তিনি এখন ইসরাইলের কারাগারে বন্দি অবস্থায় আছে। তাদের মধ্যে ৩৩ জন নারী, ১৭০ অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়ে রয়েছে।

ফিলিস্তিনকে সমর্থন জানালো চীন : চীন ফিলিস্তিনি ও ইসরাইলিদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা ও সহিংসতা নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন এবং সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলিকে শান্ত থাকার এবং সংযম অনুশীলন করার আহ্বান জানিয়েছে, রোববার চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেছেন। ইতিমধ্যে দ্বিতীয় দিনে পা গড়িয়েছে ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতারা এ সংঘাত বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানিসহ পশ্চিমা দেশগুলোর অধিকাংশই ইসরাইলের পাশে অবস্থান নিয়েছে। তবে এই সংঘাতের অবসানে ইসরাইল-ফিলিস্তিন দুটি আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকেই একমাত্র সমাধান হিসেবে বিবেচনা করছে চীন।

এ বিষয়ে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, সংঘাত বৃদ্ধির ফলে শান্তি প্রক্রিয়ায় দীর্ঘস্থায়ী স্থবিরতা দেখা দিতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের বাস্তবায়ন ও স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই চলমান সংকট থেকে মুক্তির একমাত্র উপায়। তিনি আরও বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দ্রুত স্থায়ী শান্তির উপায় খুঁজে বের করতে হবে। স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় আলোচনা বাড়ানোর পাশাপাশি ফিলিস্তিন-ইসরাইলের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার আলোচনা পুনরায় শুরুর প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে। এদিকে, ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতে চীনের এই অবস্থানেক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে তেল আবিব। বেইজিংয়ে নিযুক্ত ইসরাইলের দূতাবাসের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ইউভাল ওয়াকস বলেন, ইসরাইল চীনকে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে দেখে, তাই আমরা চীনের কাছ থেকে হামাসের এ হামলার বিষয়ে ‘কঠোর নিন্দা’ আশা করেছিলাম। এখন দ্বি-রাষ্ট্রীয় সমাধানের আহ্বান জানানোর সময় না।

ইসরাইলে ঢুকে হামলা চালায় মাত্র ৩০০ যোদ্ধা : শনিবার সকালে স্বাধীনতাকামী ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাসের মাত্র ২০০ থেকে ৩০০ জন যোদ্ধা দখলদার ইসরাইলের ভূখ-ে ঢুকে হামলা চালায়, হারেৎজ সংবাদপত্র জানিয়েছে। তাদের হামলার সামনে অসহায় হয়ে পড়ে সর্বাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত ইসরাইলি সেনা। এক ইসরাইলি পুলিশ কর্মকর্তার বরাত দিয়ে সংবাদপত্রটি বলেছে, ওই কয়েক ডজন যোদ্ধা এখনো ইসরাইলের ভূখ-ে সক্রিয় থাকতে পারে। শনিবার ভোরে গাজা উপত্যকা থেকে ইসরাইলি ভূখ-ে রকেট হামলা চালানো হয়। সকাল থেকেই তেল আবিব এলাকা এবং এর আশেপাশের এলাকা সহ সারা দেশের অনেক এলাকায় অ্যালার্ম সংকেত বাজছে। এর কিছুক্ষণ পরে, ইসরাইল প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) ঘোষণা করে যে, তারা ফিলিস্তিনি এক্সক্লেভ থেকে আসা এই হামলার প্রতিশোধ হিসেবে অপারেশন ‘আয়রন সোর্ডস’ অপারেশন শুরু করছে।

এ পরিস্থিতিতে, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট রিজার্স্টদের একটি আহ্বান অনুমোদন করেছেন এবং গাজা সীমান্ত থেকে ৮০ কিলোমিটারের মধ্যে ‘বিশেষ পরিস্থিতি’ ঘোষণা করেছেন। শনিবার গভীর রাতে ইসরাইলের পুরো ভূখ-ে জরুরি অবস্থা সম্প্রসারিত করা হয়। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলেছেন যে, তার দেশ ‘যুদ্ধে’ এবং এটি জয় করতে বদ্ধপরিকর। ‘শত্রুকে নজিরবিহীন মূল্য দিতে হবে,’ তিনি যোগ করেছেন। সূত্র : আল-জাজিরা, বিবিসি, তাস।